মালঞ্চ
পাশে এসে বসলে। অনেকক্ষণ চুপ করে রইল দুই জনেই।

সরলা। রমেনদা, জেলে যাওয়া যায় কী করে, পরামর্শ দাও আমাকে।

রমেন। জেলে যাবার রাস্তা এত অসংখ্য এবং আজকাল এত সহজ যে কী করে জেলে না যাওয়া যায় সেই পরামর্শই কঠিন হয়ে উঠল। এ যুগে গোরার বাঁশি ঘরে টিঁকতে দিল না।

সরলা। না, আমি ঠাট্টা করছি নে, অনেক ভেবে দেখলুম আমার মুক্তি ঐখানেই।

রমেন। ভালো করে খুলে বলো তোমার মনের কথাটা।

সরলা। বলছি সব কথা। সম্পূর্ণ বুঝতে পারতে যদি আদিৎদার মুখখানা দেখতে পেতে।

রমেন। আভাসে কিছু দেখেছি।

সরলা। আজ বিকেলবেলায় একলা ছিলেম বারান্দায়। আমেরিকা থেকে ফুলগাছের ছবি-দেওয়া ক্যাটালগ এসেছে, দেখছিলেম পাতা উলটিয়ে, রোজ বিকেলে সাড়ে চারটার মধ্যে চা খাওয়া সেরে আদিৎদা আমাকে ডেকে নেন বাগানের কাজে। আজ দেখি অন্যমনে বেড়াচ্ছেন ঘুরে ঘুরে। মালীরা কাজ করে যাচ্ছে তাকিয়ে দেখছেন না। মনে হল আমার বারান্দার দিকে আসবেন বুঝি, দ্বিধা করে গেলেন ফিরে. অমন শক্ত লম্বা মানুষ, জোরে চলা, জোরে কাজ, সবদিকেই সজাগ দৃষ্টি, কড়া মনিব অথচ মুখে ক্ষমার হাসি; আজ সেই মানুষের সেই চলন নেই, দৃষ্টি নেই বাইরে, কোথায় তলিয়ে আছেন মনের ভিতরে। অনেকক্ষণ পরে ধীরে ধীরে এলেন কাছে। অন্যদিন হলে তখনি হাতের ঘড়িটা দেখিয়ে বলতেন, সময় হয়েছে, আমিও উঠে পড়তুম। আজ তা না বলে আস্তে আস্তে পাশে চৌকি টেনে নিয়ে বসলেন। বললেন, “ক্যাটালগ দেখছ বুঝি?” আমার হাত থেকে ক্যাটালগ নিয়ে পাতা ওলটাতে লাগলেন, কিছু যে দেখলেন তা মনে হল না। হঠাৎ একবার আমার মুখের দিকে চাইলেন, যেন পণ করলেন আর দেরি না করে এখনি কী একটা বলাই চাই। আবার তখনি পাতার দিকে চোখ নামিয়ে বললেন, “দেখেছ সরি, কত বড়ো ন্যাসটার্শিয়াম”। কণ্ঠে গভীর ক্লান্তি। তার পর অনেকক্ষণ কথা নেই, চলল পাতা ওলটানো. আর-একবার হঠাৎ আমার মুখের দিকে চাইলেন, চেয়েই ধাঁ করে বই বন্ধ করে আমার কোলের উপর ফেলে দিয়ে উঠে পড়লেন। আমি বললেম, “যাবে না বাগানে?” আদিৎদা বললেন, ‘না ভাই, বাইরে বেরোতে হবে, কাজ আছে।’ বলেই তাড়াতাড়ি নিজেকে যেন ছিঁড়ে নিয়ে চলে গেলেন।

রমেন। আদিৎদা তোমাকে কী বলতে এসেছিলেন, কী আন্দাজ করো তুমি।

সরলা। বলতে এসেছিলেন, তোমার এক বাগান ভেঙেছে, এবার হুকুম এল তোমার কপালে আর-এক বাগান ভাঙবে।

রমেন। তাই যদি ঘটে সরি, তা হলে জেলে যাবার স্বাধীনতা যে আমার থাকবে না।

সরলা। (ম্লান হেসে) তোমার সে রাস্তা কি আমি বন্ধ করতে পারি? সম্রাট বাহাদুর স্বয়ং খোলাসা রাখবেন।

রমেন। তুমি বৃন্তচ্যুত হয়ে পড়ে থাকবে রাস্তায়, আর আমি শিকলে ঝংকার দিতে দিতে চমক লাগিয়ে চলব জেলখানায়, এ কি কখনো হতে পারে? এখন থেকে তা হলে যে আমাকে এই বয়সে ভালোমানুষ হতে শিখতে হবে।

সরলা। কী করবে তুমি?

রমেন। তোমার অশুভগ্রহের সঙ্গে লড়াই ঘোষণা করে দেব। কুষ্টি থেকে তাকে তাড়াব। তার পরে লম্বা ছুটি পাব, এমন-কি, কালাপানির পার পর্যন্ত।

সরলা। তোমার কাছে কোনো কিছুই লুকোতে পারি নে। একটা কথা আমার কাছে স্পষ্ট হয়ে উঠেছে কিছুদিন থেকে। আজ সেটা তোমাকে বলব, কিছু মনে কোরো না।