প্রজাপতির নির্বন্ধ
                                যাও ঠাকুর চৈতন চুটকি নিয়া,
                                এসো দাড়ি নাড়ি কলিমদ্দি মিঞা!

যতই উৎসাহসহকারে গান চলিল, দ্বারের পার্শ্ব হইতে উসখুস শব্দ শুনা যাইতে লাগিল এবং অক্ষয় নিরীহ ভালোমানুষটির মতো মাঝে মাঝে সেই দিকে কটাক্ষপাত করিতে লাগিলেন।

এমন সময় ময়লা ঝাড়ন হাতে কলিমদ্দি আসিয়া সেলাম করিয়া দাঁড়াইল। দারুকেশ্বর উৎসাহিত হইয়া কহিল, “এই-যে চাচা! আজ রান্নাটা কী হয়েছে বলো দেখি।”

সে অনেকগুলা ফর্দ দিয়া গেল। দারুকেশ্বর কহিল, “কোনোটাই তো মন্দ শোনাচ্ছে না হে। (অক্ষয়ের প্রতি) মশায়, কী বিবেচনা করেন? ওর মধ্যে বাদ দেবার কি কিছু আছে?”

অক্ষয় অন্তরালের দিকে কটাক্ষ করিয়া কহিলেন “সে আপনারা যা ভালো বোঝেন!”

দারুকেশ্বর কহিল, “আমার তো মত, ব্রাহ্মণেভ্যো নমঃ বলে সব-কটাকেই আদর করে নিই।”

অক্ষয়। তা তো বটেই, ওঁরা সকলেই পূজ্য।

কলিমদ্দি সেলাম করিয়া চলিয়া গেল। অক্ষয় কিঞ্চিৎ গলা চড়াইয়া জিজ্ঞাসা করিলেন, “মশায়রা কি তা হলে আজ রাত্রেই ক্রিশ্চান হতে চান?”

খানার আশ্বাসে প্রফুল্লচিত্তে দারুকেশ্বর কহিল,“আমার তো কথাই আছে, শুভস্য শীঘ্রং। আজই ক্রিশ্চান হব, এখনই ক্রিশ্চান হব, ক্রিশ্চান হয়ে তবে অন্য কথা। মশায়, আর ঐ পুঁইশাক কলাইয়ের ডাল খেয়ে প্রাণ বাঁচে না। আনুন আপনার পাদ্রি ডেকে।” বলিয়া পুনশ্চ উচ্চস্বরে গান ধরিল–
                                যাও ঠাকুর চৈতন চুটকি নিয়া,
                                এসো দাড়ি নাড়ি কলিমদ্দি মিঞা!

চাকর আসিয়া অক্ষয়ের কানে কানে কহিল, “মাঠাকরুন একবার ডাকছেন।”

অক্ষয় উঠিয়া দ্বারের অন্তরালে গেলে জগত্তারিণী কহিলেন, “এ কী! কাণ্ডটা কী?”

অক্ষয় গম্ভীরমুখে কহিলেন, “মা, সে-সব পরে হবে, এখন ওরা হুইস্কি চাচ্ছে, কী করি? তোমার পায়ে মালিশ করবার জন্যে সেই-যে ব্রাণ্ডি এসেছিল, তার কি কিছু বাকি আছে?”

জগত্তারিণী হতবুদ্ধি হইয়া কহিলেন, “বল কী বাছা? ব্রাণ্ডি খেতে দেবে?”

অক্ষয় কহিলেন, “কী করব মা, শুনেইছ তো, ওর মধ্যে একটি ছেলে আছে যার জল খেলেই সর্দি হয়, মদ না খেলে আর-একটির মুখে কথাই বের হয় না।”

জগত্তারিণী কহিলেন, “ক্রিশ্চান হবার কথা কী বলছে ওরা?”

অক্ষয় কহিলেন, “ওরা বলছে হিঁদু হয়ে খাওয়া-দাওয়ার বড়ো অসুবিধে, পুঁইশাক কলাইয়ের ডাল খেয়ে ওদের অসুখ করে!”

জগত্তারিণী অবাক হইয়া কহিলেন, “তাই বলে কি ওদের আজ রাতেই মুর্গি খাইয়ে ক্রিশ্চান করবে নাকি?”

অক্ষয় কহিলেন, “তা, মা, ওরা যদি রাগ করে চলে যায় তা হলে দুটি পাত্র এখনই হাতছাড়া হবে। তাই ওরা যা বলছে তাই শুনতে হচ্ছে, আমাকে সুদ্ধ মদ ধরাবে দেখছি।”

পুরবালা কহিলেন, “বিদায় করো, বিদায় করো, এখনই বিদায় করো।”

জগত্তারিণী ব্যস্ত হইয়া কহিলেন, “বাবা, এখানে মুর্গি খাওয়া-টাওয়া হবে না, তুমি ওদের বিদায় করে দাও।