প্রজাপতির নির্বন্ধ
                                    দেবে লিখে রাজার টিকে প্রসন্ন ওই চোখ!

শৈলবালার প্রস্থান। ভৃত্য আদিষ্ট হইয়া দুটি ভদ্রলোককে উপস্থিত করিল। একটি বিসদৃশ লম্বা, রোগা, বুট-জুতা পরা, ধুতি প্রায় হাঁটুর কাছে উঠিয়াছে, চোখের নীচে কালী-পড়া, ম্যালেরিয়া রোগীর চেহারা– বয়স বাইশ হইতে বত্রিশ পর্যন্ত যেটা খুশি হইতে পারে। আর-একটি বেঁটেখাটো, অত্যন্ত দাড়ি-গোঁফ-সংকুল, নাকটি বটিকাকার, কপালটি ঢিবি, কালোকোলো, গোলগাল।

অক্ষয় অত্যন্ত সৌহার্দ্যসহকারে উঠিয়া অগ্রসর হইয়া প্রবল বেগে শেকহ্যান্ড করিয়া দুটি ভদ্রলোকের হাত প্রায় ছিঁড়িয়া ফেলিলেন। বলিলেন, “আসুন মিস্টার ন্যাথানিয়াল, আসুন মিস্টার জেরেমায়া, বসুন বসুন! ওরে বরফ-জল নিয়ে আয় রে, তামাক দে!”

রোগা লোকটি সহসা বিজাতীয় সম্ভাষণে সংকুচিত হইয়া মৃদুস্বরে বলিল, “আজ্ঞে, আমার নাম মৃত্যুঞ্জয় গাঙ্গুলি।”

বেঁটে লোকটি বলিল, “আমার নাম শ্রীদারুকেশ্বর মুখোপাধ্যায়।”

অক্ষয়। ছি মশায়! ও নামগুলো এখনো ব্যবহার করেন বুঝি? আপনাদের ক্রিশ্চান নাম?

আগন্তুকদিগকে হতবুদ্ধি নিরুত্তর দেখিয়া কহিলেন, “এখনো বুঝি নামকরণ হয় নি? তা, তাতে বিশেষ কিছু আসে যায় না, ঢের সময় আছে।”

বলিয়া নিজের গুড়গুড়ির নল মৃত্যুঞ্জয়ের হাতে অগ্রসর করিয়া দিলেন। সে লোকটা ইতস্তত করিতেছে দেখিয়া বলিলেন,“বিলক্ষণ!আমার সামনে আবার লজ্জা! সাত বছর বয়স থেকে লুকিয়ে তামাক খেয়ে পেকে উঠেছি। ধোঁওয়া লেগে লেগে বুদ্ধিতে ঝুল পড়ে গেল! লজ্জা যদি করতে হয় তা হলে আমার তো আর ভদ্রসমাজে মুখ দেখাবার জো থাকে না।”

তখন সাহস পাইয়া দারুকেশ্বর মৃত্যুঞ্জয়ের হাত হইতে ফস করিয়া নল কাড়িয়া লইয়া ফড়ফড় শব্দে টানিতে আরম্ভ করিল। অক্ষয় পকেট হইতে কড়া বর্মা চুরোট বাহির করিয়া মৃত্যুঞ্জয়ের হাতে দিলেন। যদিচ তাহার চুরোট অভ্যাস ছিল না, তবু সে সদ্যস্থাপিত ইয়ার্কির খাতিরে প্রাণের মায়া পরিত্যাগ করিয়া মৃদুমন্দ টান দিতে লাগিল এবং কোনো গতিকে কাসি চাপিয়া রাখিল।

অক্ষয় কহিলেন, “এখন কাজের কথাটা শুরু করা যাক। কী বলেন?”

মৃত্যুঞ্জয় চুপ করিয়া রহিল, দারুকেশ্বর বলিল, “তা নয় তো কী? শুভস্য শীঘ্রং!” বলিয়া হাসিতে লাগিল, ভাবিল, ইয়ার্কি জমিতেছে।

তখন অক্ষয় গম্ভীর হইয়া জিজ্ঞাসা করিলেন, “মুর্গি না মটন!”

মৃত্যুঞ্জয় অবাক হইয়া মাথা চুলকাইতে লাগিল। দারুকেশ্বর কিছু না বুঝিয়া, অপরিমিত হাসিতে আরম্ভ করিল। মৃত্যুঞ্জয় ক্ষুব্ধ লজ্জিত হইয়া ভাবিতে লাগিল, এরা দুজন তো বেশ জমাইয়াছে, আমিই নিরেট বোকা!

অক্ষয় কহিলেন, “আরে মশায়, নাম শুনেই হাসি! তা হলে তো গন্ধে অজ্ঞান এবং পাতে পড়লে মারাই যাবেন! তা, যেটা হয় মন স্থির করে বলুন– মুর্গি হবে না মটন হবে?”

তখন দুজনে বুঝিল, আহারের কথা হইতেছে। ভীরু মৃত্যুঞ্জয় নিরুত্তর হইয়া ভাবিতে লাগিল। দারুকেশ্বর লালায়িত রসনায় এক বার চারি দিকে চাহিয়া দেখিল।

অক্ষয় কহিলেন, “ভয় কিসের মশায়? নাচতে বসে ঘোমটা?”
শুনিয়া দারুকেশ্বর দুই হাতে দুই পা চাপড়াইয়া হাসিতে লাগিল। কহিল, তা, “মুর্গিই ভালো, কট‍্‍লেট! কী বলেন?”

লুব্ধ মৃত্যুঞ্জয় সাহস পাইয়া বলিল, “মটনটাই বা মন্দ কী ভাই! চপ– ”