বঙ্গে সমাজ-বিপ্লব
বিশৃঙ্খলা অধিকদিন তিষ্ঠিতে পারে না। প্রাকৃতিক ঘটনায় এক-একটি যে বিপ্লব বিশৃঙ্খলা দেখিতে পাওয়া যায়, সে-সকল প্রকৃতির কার্য-শৃঙ্খলারই একটি অঙ্গ। বিপ্লব-বিশৃঙ্খলার অর্থই এই যে,এখন যে অবস্থা আছে ইহা এখানকার সময়ের উপযোগী নহে। ইহা পরিবর্তিত না হইলে সমূহ অনিষ্ট হইবে। বর্তমানে যখনই বিপ্লব দেখিবে, তখনই জানিব যে, ভূতকালের যে ভিত্তির উপর দাঁড়াইয়া আছি, তাহা জীর্ণ বা অকর্মন্য হইয়া গিয়াছে, ভবিষ্যতে পুনঃ-সংস্কার হইবে। যেখানকার বায়ু লঘু হইয়া যাইবে, সেইখানেই চারি দিক হইতে বায়ুর স্রোত আসিয়া একটি ঝটিকা বাধিবে বটে, কিন্তু তাহার ফল এই হইবে যে, বায়ু পুনরায় স্বাভাবিক অবস্থা প্রাপ্ত হইবে। মনুষ্যের সামাজিক রাজ্যেও সেইরূপ এক-এক সময় ঝঞ্ঝা ঝটিকা বহিতে থাকে, তখন সকলেই ভয় করেন যে, বুঝি সমাজের সমুদয় শৃঙ্খলা উলটপালট হইয়া যায়। কিন্তু তাঁহাদের ভয় করিবার কোনো কারণ নাই ; তাঁহারা যদি ভবিষ্যৎ দেখিতে পাইতেন, তো দেখিতেন যে, জীর্ণ সমাজের কতক কতক ভগ্ন ও চূর্ণ হইয়া গিয়াছে বটে, কিন্তু আবার দৃঢ়তর উপাদানে নূতন সমাজ নির্মিত হইয়াছে। রাজপুরুষের একাধিপত্য অনেকদিন য়ুরোপ-খন্ডে চলিয়া আসিতেছিল, হয়তো ততদিন প্রয়োজন ছিল, কিন্তু যখনই সে সময় অতীত হইয়া গেল, অমনই একটা বিপ্লব বাধিল; দারুণ রক্তপাত, অরাজকতা, অত্যাচার উপস্থিত হইল, কিন্তুপরিণাম তাহা হইতে অশুভ ফল উৎপন্ন হইল না। অসভ্য অবস্থায় অসাধারণ পরাক্রমশালী প্রভুর প্রয়োজন ছিল, নচেৎ তখনকার দুর্দান্ত লোকেরা যুক্তিতে বা সুমিষ্ট ব্যবহারে বশ হইত না, কিন্তু সে অবস্থা চলিয়া গেলে সে নিয়ম খাটিল না। এক কথায় বলিতে গেলে বিপ্লব আপাতত অতিশয় বিকটাকার বোধ হইলেও পরিণামে তাহা হইতে অনেক শুভ ফল উৎপন্ন হয়। লন্ডনে যখন দারুণ মড়ক হইয়াছিল, তখন যে অগ্নিদাহ হয়, তাহা হইতে যদিও অনেক অনিষ্ট ঘটিয়াছিল, কিন্তু মড়কের বীজ দগ্ধ হইয়া গুরুতর অনিষ্ট নিরাকৃত হয়।

বঙ্গদেশের প্রাচীন লোকেরা সভয়ে দেখিতেছেন যে, নূতন বংশের অভ্যুত্থানশীল যুবকদের মধ্যে অতিশয় বিপ্লব চলিতেছে। তাঁহারা ভাবিতেছেন, কলির সন্ধ্যাকাল বুঝি উপস্থিত হইয়াছে; কেহ কাহাকে মানে না, সকলে স্ব স্ব প্রধান, স্বদেশ-সম্বন্ধে অভিজ্ঞ বৃদ্ধদের কাছে তহারা পরামর্শ চায় না, বিদেশের সর্ববিদ্যাভিমানী গ্রন্থকারের কথাই তাহাদের বেদবাক্য, প্রাচীন প্রথার অনুসরণ করিতে নিতান্ত বিমুখ, এবং ভালোই হউক আর মন্দই হউক তাহা লঙঘন করিতে পারিলে আপনাকে মহাবীর বলিয়া মনে করে, সকলেই মনে করে, আমারই উপর বিধাতা এই অসভ্য বঙ্গদেশের সংস্কারের ভার অর্পন করিয়াছেন, আমার কথাতেই সকলে চলিবে, আমি কাহারো কথায় চলিব না, এবং যাঁহারা একবার বিশ্ববিদ্যালয়ে পদার্পণ করেন বা তথা হইতে নির্গত হন, তাঁহারা দেশের লোকের রুচির, জ্ঞানের, সভ্যতার দোষ ধরিয়া বেড়ান, তাঁহারা মনে করেন সকল বিষয়েই আমার অধিকার আছে, এইজন্য তিনি বুঝুন বা না বুঝুন সকল কথা লইয়াই তোলাপাড়া করিয়া থাকেন। যাহা হউক, আমাদের এই নব্য বংশ এখনও বৃদ্ধদের শাসনে আছেন, কিন্তু যখন এই প্রাচীন বংশ লোপ পাইবেক, তখন এই যথেচ্ছাচারী শত শত শিক্ষিত লোক কী গোলযোগ বাধাইবেন কে বলিতে পারে। এই-সকল ভাবিয়া অনেক ভয় পাইতেও পারেন, কিন্তু আমরা বলি এ বিপ্লব চিরকাল থাকিবে না। নিদ্রোন্মীলিত নয়নে নূতন জ্ঞানের আলোক লাগিয়া বঙ্গবাসীরা অন্ধ হইয়া গিয়াছেন, তাঁহারা দিগ‍্‌বিদিক্- শূন্য হইয়া কী করিবেন ভাবিয়া পাইতেছেন না। যখন এই আলোক তাঁহাদের চক্ষে সহিয়া যাইবে, তখন আবার তাঁহারা চারি দিক স্পষ্টতর দেখিতে পাইবেন এবং দেশ-কাল-পাত্র বুঝিয়া কর্তব্যাকর্তব্য নির্ধারিত করিতে পারিবেন। তাঁহারা পারিবারিক সুখের বন্ধন ছিঁড়িয়া ফেলাকেই স্বাতন্ত্র্য মনে করেন, যথেচ্ছারিতাকেই স্বাধীনতা বলিয়া আলিঙ্গন করেন ও স্বদেশকে ঘৃণা করাকেই সার্বভৌমিক ভাব মনে করেন। এ অবস্থা