শ্রীযুক্ত চারুচন্দ্র দত্ত বন্ধুবরেষু

আমার বয়স ছিল সতেরো।পড়াশুনোয় ফাঁকি দিয়ে গুরুজনের উদ্‌বেগভাজন হয়েছি।মেজদাদা তখন আমেদাবাদে জজিয়তি করছেন।ভদ্রঘরের ছেলের মানরক্ষার উপযুক্ত ইংরেজি যে-করে-হোক জানা চাই; সেজন্য আমরা বিলেত-নির্বাসন ধার্য হয়েছে। মেজদাদার ওখানে কিছুদিন থেকে পত্তন করতে হবে তার প্রথম ভিত,হিতৈষীরা এই স্থির করেছেন। সিভিল সার্ভিসের রঙ্গভূমিতে আমরা বিলিতি কায়দায় নেপথ্যবিধান হল।

বালক-বয়সে আত্মপ্রকাশটা থাকে চাপা। জীবনে তখন উপরওলাদেরই আধিপত্য;চলৎশক্তির স্বাতন্ত্র্যটা দখল করে আদেশ উপদেশ অনুশাসন। স্বভাবত মেনে-চলবার মন আমার নয়,কিন্তু আমি ছিলুম ভোলা মনের মানুষ,আপন খেয়াল নিয়ে থাকতুম,আমাকে দেখতে হত নেহাত ভালোমানুষের মতো। ভাবীকালে বিস্তর কথাই কইতে হয়েছে,তার অঙ্কুরোদগম ছিল নিঃশব্দে।একদিন যখন বারান্দার রেলিং ধরে একলা চুপ করে বসে ছিলুম,পাশ দিয়ে যেতে যেতে বড়দাদা আমার মাথা নাড়া দিয়ে বললেন,রবি হবে ফিলজফর। চুপ করে থাকার খেতে ফিলজফি ছাড়াও অন্য ফসল ফলে।

খেতে প্রথম দেখা দিল কাঁটাগাছ,চাষ-না-করা জমিতে। বিশ্বকে খোঁচা মেরে আপন অস্তিত্ব প্রমান করবার সেই ঔদ্ধত্য। হরিণ-বালকের প্রথম শিং উঠলে তার যে চাল হয় সেই উগ্র চাল প্রথম কৈশোরের। বালক আপন বাল্যসীমা পেরোবার সময় সীমা লঙ্ঘন করতে চায় লাফ দিয়ে। তার পরিচয় শুরু হয়েছিল মেঘনাদবধকাব্যের সমালোচনা যখন লিখেছিলাম পনেরো বছর বয়সে। এই সময়েই যাত্রা করেছি বিলেতে। চিঠি যেগুলো লিখেছিলুম তাতে খাঁটি সত্য বলার চেয়ে খাঁটি স্পর্ধা প্রকাশ পেয়েছে প্রবল বেগে।বাঙালির ছেলে প্রথম বিলেতে গেলে তার ভালো লাগবার অনেক কারণ ঘটে। সেটা স্বাভাবিক,সেটা ভালোই। কিন্তু কোমর বেঁধে বাহাদুরি করবার প্রবৃত্তিতে পেয়ে বসলে উলটো মূর্তি ধরতে হয়।বলতে হয়,আমি অন্য পাঁচজনের মতো নই, আমার ভালো লাগবার যোগ্য কোথাও কিছুই নেই। সেটা যে চিত্তদৈন্যের লজ্জাকর লক্ষণ এবং অর্বাচীন মূঢ়তার শোচনীয় প্রমাণ,সেটা বোঝবার বয়স তখনো হয় নি।

সাহিত্য সাবালক হওয়ার পর থেকেই ঐ বইটার 'পরে আমার ধিক্‌কার জন্মেছিল। বুঝেছি,যে-দেশে গিয়েছিলুম সেখানকারই যে সম্মানহানি করা হয়েছে তা নয়,ওটাতে নিজেদেরই সম্মানহানি। বিস্তর লোকের বার বার অনুরোধ সত্ত্বেও বইটা প্রকাশ করি নি। কিন্তু আমি প্রকাশে বাধা দিলেই ওটা যে অপ্রকাশিত থাকবে এই কৌতূহলমুখর যুগে তা আশা করা যায় না। সেইজন্যে এ লেখার কোন্ কোন্ অংশে লেখক স্বয়ং গ্রাহ্য ও ত্যাজ্য বলে স্বীকার করেছে সেটা জানিয়ে রেখে দিলুম।যথাসময়ে ময়লার ঝুলি হাতে আবর্জনা কুড়োবার লোক আসবে,বাজারে সেগুলো বিক্রি হবার আশঙ্কাও যথেষ্ট আছে। অনেক অপরাধের অনেক প্রায়শ্চিত্ত বাকি থাকে ইহলোক প্রেতলোকে সেগুলো সম্পূর্ণ হতে থাকে।

এই বইটাকে সাহিত্যের পঙ্‌‌ক্তিতে আমি বসাতে চাই,ইতিহাসের পঙ্‌‌ক্তিতে নয়।পাঠ্য জিনিসেরই মূল্য সাহিত্যে,অপাঠ্য জিনিসেরও মূল্য ইতিহাসে। ঐতিহাসিককে যদি সম্পূর্ণ বঞ্চিত করতে পারতুম তবে আমার পক্ষে সেটা পূণ্যকর্ম,সুতরাং মুক্তির পথ হত। নিজের কাব্য সম্বন্ধে এই ত্যাগের সাধনায় প্রবৃত্ত হতে বার বার সংকল্প করেছি। কিন্তু দুর্বল মন সংঘবদ্ধ আপত্তির বিরুদ্ধে ব্রতপালন করতে পারি নি।বাছাই করবার ভার দিতে হল পরশুপাণি মহাকালের হাতে। কিন্তু মুদ্রাযন্ত্রের যুগে মহাকালেরও কর্তব্যে ত্রুটি ঘটছে। বইগুলির বৈষয়িক স্বত্ব হারিয়েছি বলে আরো দুর্বল হতে হল আমাকে।

য়ুরোপ-প্রবাসীর পত্রশ্রেণী আগাগোড়া অরক্ষণীয়া নয়। এর স্বপক্ষে একটা কথা আছে সে হচ্ছে এর ভাষা।নিশ্চিত বলতে পারি নে কিন্তু আমার বিশ্বাস,বাংলা সাহিত্যে চলতি ভাষার লেখা বই এই প্রথম। আগ এর বয়স হল ষাট। সে-ক্ষেত্রেও আমি ইতিহাসের দোহাই দিয়ে কৈফিয়েত দাখিল করব না। আমার বিশ্বাস বাংলা চলতি ভাষার সহজ প্রকাশপটুতার প্রমাণ এই চিঠিগুলির মধ্যেই আছে।