[কাব্য]
কাব্যের আসল জিনিস কোন্‌টা তাহা লইয়া সর্বদাই বকাবকি হইয়া থাকে কিন্তু প্রায় কোনো মীমাংসা হয় না। এ সম্বন্ধে আমার মত আমি সংগীত ও কবিতা নামক প্রবন্ধে বাল্যকালে লিখিয়াছিলাম, এই খাতায় সংক্ষেপে তাহারই পুনরুক্তি করিতে বসিলাম।

... এইখানে আমি এমন একটা কথা বলিতে চাহি যাহা শুনিতে অত্যন্ত বাষ্পময় কাল্পনিক মনে হইতে পারে কিন্তু যাহা আমি একান্ত প্রকৃত সত্য বলিয়া বিশ্বাস করি।–জগতের সমস্ত বিষয়ের মধ্যেই অসীমতা আছে; যাহাকে আমরা সুন্দর বলিয়া অনুভব করি এবং ভালোবাসি, তাহার মধ্যেই সেই অসীমতা আমরা কিয়ৎ পরিমাণে উপভোগ করিতে পারি। অতএব কোনো সৌন্দর্য সম্বন্ধে কেহ শেষ কথা বলিতে পারে না। কোনো ফুলের সম্বন্ধে পৃথিবীর আদি কবি যাহা বলিয়াছেন তাহাতে তিনি তাহার সৌন্দর্যের শেষ করিয়া যাইতে পারেন নাই। তাঁহার পরবর্তী কবি যদি আরও কিছু বলিয়া থাকেন তবে তাহা সেই ক্ষুদ্র ফুলের পক্ষে অধিক হয় না। বিষয়টা একই এবং পুরাতন কিন্তু আদিকাল হইতে এখানো পর্যন্ত মানুষ তাহার নূতনত্ব শেষ করিতে পারে নাই! আমি একটি তুচ্ছ ফুল সম্বন্ধে যতটা কথা বলিতে পারি, কোনো কবি তাহার অপেক্ষা ঢের বেশি বলিলেও যদি কথাটা অকৃত্রিম সুন্দররূপে প্রকাশ করা হয়, তাহা হইলে তৎক্ষণাৎ আমার মনে হইবে, বটে, বটে, ফুল সম্বন্ধে এতটা কথা বলা যাইতে পারে বটে! আমি যে এতদিন স্বীকার করি নাই, তাহাতে ফুলের খর্বতা নাই আমারই খর্বতা। ফুল আপনার মধ্যে অসীমতা প্রতিষ্ঠিত করিয়া সুন্দর হইয়া দাঁড়ইয়া আছে-যাহার যতটা ক্ষমতা সে ততটা অনুভব করে।

অতএব এখানে বিষয় লইয়া কথা নহে, প্রকাশ লইয়া কথা। জুঁইফুল সুন্দর এ কথা বড়ো কবিও জানে ছোটো কবিও জানে, অকবিও জানে–কিন্তু যে যত ভালো করিয়া প্রকাশ করে জুঁইফুলকে সে তত অধিক করিয়া আমার হাতে আনিয়া দেয়।

কেবল তাহাই নয়। কারণ, যদি কেবল তাহাই হইত, তাহা হইলে জুঁইফুল সম্বন্ধে সবচেয়ে বড়ো কবির কবিতা পড়িয়া তৎসম্বন্ধে আর-কোনো কবির রচনা পড়া অনাবশ্যক ও বিরক্তিজনক হইত।

কিন্তু ফুলের মধ্যে অসীমতা আছে বলিয়াই শ্রেষ্ঠ কবির কবিতায় তাহার অগাধ গভীরতা এবং ভালো মন্দ সহস্র কবির কবিতায় তাহার অপার বিস্তৃতি অনুভব করি। দেখিতে পাই, কালের অনেক পরিবর্তন হইয়াছে এবং মানবের মধ্যে অনেক বৈচিত্র্য আছে কিন্তু তথাপি সর্বকালে সর্বকবির মধ্যে এই ফুলের সমাদর। এইজন্য এক কবির পরে আর-এক কবি যখন একই পুরাতন কথা বলে তখন ফুলের অসীমতার প্রতি আমরা আরও একটু নূতন করিয়া অগ্রসর হই।

ফুলের মধ্যে প্রবেশ করিবার একটিমাত্র পথ আছে–তাহার বাহ্যিক সৌন্দর্য; আমাদের সমগ্র মানবত্ব তাহার মধ্যে আপনার স্থান করিয়া লইবার উপায় পায় না; এইজন্য ফুলে আমাদের আংশিক আনন্দ। কোনো কোনো কবির কবিতায় এই ফুলকে কেবলমাত্র জড়সৌন্দর্যভাবে না দেখিয়া ইহার মধ্যে আমাদের অনুরূপ মনোভাব এবং আত্মা কল্পনা করিয়া লইয়া আমাদের আনন্দ অপেক্ষাকৃত সংগতি প্রাপ্ত হয়।

যাহাদের কিছুমাত্র কল্পনাশক্তি আছে তাহারা সৌন্দর্যকে নির্জীবভাবে দেখিতে পারে না। কারণ, সৌন্দর্য বিষয়ের একটা অতিরিক্ত পদার্থ–তাহা তাহার আবশ্যকীয় নহে। এইজন্য মনে হয় সৌন্দর্যের মধ্যে যেন একটা ইচ্ছাশক্তি, একটা আনন্দ,একটা আত্মা আছে। ফুলের আত্মা যেন সৌন্দর্যে বিকশিত ও প্রফুল্ল হইয়া উঠে, জগতের আত্মা যেন অপার বহিঃসৌন্দর্যে আপনাকে প্রকাশ করে। অন্তরের অসীমতা যেখানে বাহিরে আপনাকে প্রকাশ করিতে পারিয়াছে সেইখানেই যেন সৌন্দর্য–সেই প্রকাশ যেখানে যত অসম্পূর্ণ সেইখানে তত সৌন্দর্যের অভাব, রূঢ়তা, জড়তা, চেষ্টা, দ্বিধা ও সর্বাঙ্গীণ অসামঞ্জস্য।