হিন্দুদিগের জাতীয় চরিত্র ও স্বাধীনতা
সেদিন মোহিনী এক Theory বাহির করিয়াছিলেন যে, যে জাতি সমতলভূমিতে থাকে তাহারা অপেক্ষাকৃত ন্যায়শাস্ত্রব্যবসায়ী হয়। কথাটা নিতান্তই কাল্পনিক বোধ হয় না। যাহারা সমতলক্ষেত্রে থাকে, কষ্টস্বীকার করিয়া অতিক্রম করিবার অভ্যাস তাহাদের চলিয়া যায়, স্বভাবতই অলস হইয়া যায়। এইজন্য কোনোপ্রকার মানসিক [চিন্তা] তাহাদের পক্ষে দুঃসহ, ঘর-পড়া ন্যায়শাস্ত্রের জাদুপ্রভাবে সমস্তই তাহারা পরিষ্কার সমভূমি করিয়া দিতে চায়, সমস্তই একটা System একটা তন্ত্রের মধ্যে আনিতে চায়। তাহারা স্বাধীন মানবমন হইতে প্রসূত সাহিত্য [রচনার] একটা কল বানাইয়া দিয়াছে-- এমন একটা স্বভাববিরুদ্ধ অলংকারশাস্ত্র গড়িয়া দিয়াছে, যাহাতে আপন হইতে লিখিবার ল্যাঠা যথাসম্ভব ঘুচিয়া যায়। সংগীতকে তাহারা এমন রাগরাগিণীজালের মধ্যে বাঁধিয়া দিয়াছে [যাহাতে] গীতরচনা করিতে যান্ত্রিক শিক্ষা ছাড়া স্বাভাবিক ক্ষমতার বড়ো একটা আবশ্যক বোধ হয় না। সকল দুরূহ [প্রশ্নেরই] চট্‌পট্‌ একটা মীমাংসা বাহির করিয়া ফেলে। কিছুতেই যখন পাওয়া যায় না তখন একটা গল্প তৈরি করে। পঞ্চপাণ্ডব যে এক স্ত্রী বিবাহ করিল সেটা যেম্‌নি বুঝিতে একটু গোল বাধে অম্‌নি তাহার গল্প বাহির হয়। [ইহ]জন্মে যাহার নিকাশ পাওয়া যায় না পূর্বজন্ম হইতে তাহার কৈফিয়ত তলব হয়। কিছুই অমীমাংসিত থাকে না। যাহারা সকল বিষয়েরই চরম মীমাংসার জন্য অতিমাত্র ব্যগ্র, তাহারা কোনো বিষয়ের প্রকৃত মীমাংসায় [পৌঁছিতে পারে] না, অথবা যদিবা পৌঁছায় তো দৈবাৎ পৌঁছায়-- কারণ তাহারা হাতের কাছে যাহা পায় তাহাকে [সত্য] মানিয়া নিষ্কৃতি পাইতে চাহে। Facts কাহারো মন জোগাইয়া চলে না, এইজন্য Facts-কে তাহারা [ভয় পায়]-- এইজন্য চোখ বুজিয়া বহিঃপ্রকৃতির মুখ-চাপা দিয়া নিজের মন হইতে মনের মতো তন্ত্র বাহির করিতে [চায়, এই] জন্য সমস্তটাকে অত্যন্ত Elaborate করিতে হয়-- আরম্ভের কথাগুলো অসত্য হৌক কিন্তু সেগুলিকে মানিয়া [লইলে] তাহার পরে তাহাদের মধ্যে একটা সুবিস্তৃত জটিল সামঞ্জস্য স্থাপন করা আবশ্যক হয়, নহিলে লোকে সেগুলিকে গ্রাহ্য করিবে না। এইজন্য প্রাণপণে Consistent হইতে হয়, যাহাতে গঠননৈপুণ্য দেখিয়াই লোকের [বিশ্বাস] জন্মে। পৃথিবীকে দেখা হয় নাই অথচ পৃথিবীর বিষয় লিখিতে হইবে এইজন্য পৃথিবীকে অবিকল একটি [বিকশিত] শতদলের ন্যায় কল্পনা করা হইল তাহার প্রত্যেক দলের স্বতন্ত্র নামকরণ হইল, সুমেরু-নামক কাল্পনিক পর্বতকে [তার] মধ্যস্থিত সুবর্ণ বীজকোষের মতো স্থাপন করা হইল, সমস্ত কল্পনার মধ্যে এমনি একটি সামঞ্জস্যপূর্ণ সুষমা প্রকাশ পাইল যে অজ্ঞ লোকের পক্ষে তাহাকে অবিশ্বাস করা দুরূহ-- এবং লোকেরাও বিশ্বাস করিবার জন্য নিরতিশয় ব্যাকুল-- অবিশ্বাসের পক্ষে যে অশান্তি ও পরিশ্রম আছে সেটুকু অলস লোকে বহন করিতে চায় না। সত্যের মধ্যে যে পরিপূর্ণ শৃঙ্খলা ও সামঞ্জস্য আছে এ কথা সত্য-- কিন্তু প্রথমত আংশিক সত্যগুলিকে খণ্ড খণ্ড বিশৃঙ্খলভাবে দেখিয়া ক্রমে যথানিয়মে সেই শৃঙ্খলাবদ্ধ সুন্দর সত্যের প্রতি ধাবমান হওয়া যায়। তাড়াতাড়ি করিতে গেলে আপনার মনের সংকীর্ণ কল্পনার ক্ষুদ্র পারিপাট্যটুকু লাভ করা যায় কিন্তু উদার প্রকৃতির বৃহৎ সামঞ্জস্য [দেখা] যায় না। টলেমির কাল্পনিক জ্যোতিষ্কমণ্ডল যতই সুবিহিত সুষম হউক-না-কেন সুষমা-সৌন্দর্যে প্রাকৃতিক জ্যোতিষ্কমণ্ডলীর সহিত তাহার তুলনা হয় না। কাল্পনিক পারিপাট্যের চর্চা করিতে গেলে ক্রমে তাহা সূক্ষ্ম হইতে সূক্ষ্ম অবস্থা প্রাপ্ত হয়, কারণ বহির্জগৎ হইতে তাহার বাধা নাই এবং তাহার টীকাভাষ্যও সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম সূত্রে [মাকড়সাজালে] প্রকৃতি আত্মন্ন হইয়া যায়-- তখনই এই কাল্পনিক জগৎই একপ্রকার সত্য হইয়া দাঁড়ায়।

আমার বিশ্বাস অন্য কোনো দেশের ধর্মশাস্ত্র লোকের আহার বিহার শয়ন নিদ্রা প্রভৃতি দিনের প্রত্যেক [মুহূর্তের] কার্য নিয়মে বাঁধিয়া দেয় নাই। আমাদের দেশেই এইরূপ অনুশাসন স্বাভাবিক এবং হয়তো আবশ্যক। আমাদের স্বাধীনতা অপহৃত হইলে আমরা বাঁচিয়া যাই-- নির্ভাবনা বাঁধা রাস্তায় চলিতে পারি। এমন-কি আমরা নিজের [স্বাতন্ত্র্য] রক্ষা করিতে পারি না-- এমন স্থলে আমাদের