ঔপনিষদ ব্রহ্ম
সত্যের পরম সত্য—আমাদের হৃদয়ের মধ্যে তিনি সকল আনন্দের পরমানন্দ, এবং আমাদের কর্মসংসারে তিনি সকল আদেশের পরমাদেশ। তিনি ওঁ।

ন তত্র সূর্য্যো ভাতি না চন্দ্রতারকং

নেমা বিদ্যুতো ভান্তি কুতোহয়মগ্নিঃ।

তমেব ভান্তমনুভাতি সর্ব্বং

তস্য ভাসা সর্ব্বমিদং বিভাতি।

তিনি যেখানে, সেখানে সূর্য্যের প্রকাশ নাই, চন্দ্রতারকের প্রকাশ নাই, বিদ্যুতের প্রকাশ নাই, এই অগ্নির প্রকাশ কোথায়? সেই জ্যোতির্ময়ের প্রকাশেই সমস্ত প্রকাশিত, তাঁহার দীপ্তিতেই সমস্ত দীপ্যমান। তিনিই ওঁ।

তদেতৎ প্রেয়ঃ পুত্রাৎ প্রেয়ো বিত্তাৎ

প্রেয়োহন্যস্মাৎ সর্ব্বস্মাৎ অন্তরতরং যদয়মাত্মা।

এই-যে অন্তরতর পরমাত্মা তিনি পুত্র হইতে প্রিয়, বিত্ত হইতে প্রিয়, সকল হইতেই প্রিয়। তিনিই ওঁ।

সত্যান্ন প্রমদিতব্যং।

ধর্ম্মান্ন প্রমদিতব্যং।

কুশলান্ন প্রমদিতব্যং।

ভূত্যৈ না প্রমদিতব্যং।

সত্য হইতে স্খলিত হইবে না, ধর্ম হইতে স্খলিত হইবে না, কল্যাণ হইতে স্খলিত হইবে না, মহত্ত্ব হইতে স্খলিত হইবে না। ইহা যাঁহার অনুশাসন তিনিই ওঁ।

অনেকে বলেন, দুর্বল মানবপ্রকৃতির সর্বপ্রকার চরিতার্থতা আমরা ঈশ্বরে পাইতে চাই; আমাদের প্রেম কেবল জ্ঞানে ও ধ্যানে পরিতৃপ্ত হয় না, সেবা করিতে চায়, আমাদের প্রকৃতির সেই স্বাভাবিক আকাঙ্খা চরিতার্থ করিবার জন্য আমরা ঈশ্বরকে মূর্ত্তিতে বদ্ধ করিয়া তাঁহাকে অশন বসন ভূষণ উপহারে পূজা করিয়া থাকি।

এ কথা সত্য যে, ব্রহ্মের মধ্যে আমরা মানবপ্রকৃতির চরম চরিতার্থতা অন্বেষণ করি; কেবল ভক্তি ও জ্ঞানের দ্বারা সেই চরিতার্থতা লাভ হইতে পারে না, সেই জন্যই শাস্ত্রে গৃহস্থকে ব্রহ্মনিষ্ঠ ও ব্রহ্মজ্ঞানী হইতে বলিয়াছেন এবং সেই সঙ্গে বলিয়াছেন, গৃহী যে যে কর্ম্ম করিবেন তাহা ব্রহ্মকে সমর্পণ করিবেন। সংসারের সমস্ত কর্তব্যপালনই ব্রহ্মের সেবা। যদি প্রতিমাকে অন্নবস্ত্র পুষ্পচন্দন দান করিয়া আমরা দেবসেবার আকাঙ্ক্ষা চরিতার্থ করি তবে তাহাতে আমাদের কর্মের মহত্ত্ব লাভ না হইয়া ঠিক তাহার বিপরীত হয়। ব্রহ্মজ্ঞানে আমাদিগকে সকল জ্ঞানের চরিতার্থতার দিকে লইয়া যায়, ব্রহ্মের প্রতি প্রীতি আমাদিগকে পুত্রপ্রীতি ও অন্য সকল প্রীতির পরম পরিতৃপ্তিতে লইয়া যায়, এবং ব্রহ্মের কর্মও সেইরূপ আমাদের শুভ চেষ্টাকে চরম মহত্ত্ব ও ঔদার্যের অভিমুখে আকর্ষণ করে। আমাদের জ্ঞান প্রেম ও কর্মের এইরূপ মহত্ত্বসাধনের জন্যই মনু গৃহীকে ব্রহ্মপরায়ণ হইতে উপদেশ দিয়াছেন। মানবপ্রকৃতির যথার্থ চরিতার্থতা তাহাতেই—ভোগে নহে, খেলায় নহে। প্রতিমাকে স্নান করাইয়া, বস্ত্র পরাইয়া, অন্ন নিবেদন করিয়া, আমাদের কর্মচেষ্টার কোন মহৎ পরিতৃপ্তি হইতেই পারে না; তাহাতে আমাদের কর্তব্যের আদর্শকে তুচ্ছ ও সংকীর্ণ করিয়া আনে। ভক্তি ও প্রীতির উদারতা অনুসারে কর্মেরও উদারতা ঘটিয়া থাকে। পরিবারের প্রতি যাহার যে পরিমাণে প্রীতি সেই পরিবারের জন্য সেই পরিমাণে প্রাণপাত করিয়া থাকে। দেশের প্রতি যাহার ভক্তি, দেশের সর্বপ্রকার দৈন্য ও কলঙ্ক-মোচনের জন্য বিবিধ দুরূহ চেষ্টায় প্রবৃত্ত হইয়া সে আপন ভক্তির স্বাভাবিক চরিতার্থতা সাধন করিয়া থাকে। ব্রহ্মের প্রতি যাহার গভীর নিষ্ঠা, সে পরিবারের প্রতি,