ঔপনিষদ ব্রহ্ম
তো সহজ নহে, ব্রহ্মলাভ ত সহজ নহে, সে কথা সকলেই বলে—দুর্গং পথস্তৎ কবয়ো বদন্তি-সেই জন্যই মোহনিদ্রাগ্রস্ত সংসারীর দ্বারে দাঁড়াইয়া ঋষি উচ্চস্বরে ডাকিতেছেন; উত্তিষ্ঠত জাগ্রত। না উঠিলে, না জাগিলে এই ক্ষুরধারনিশিত দুর্গম দুরত্যয় পথে চক্ষু মুদিয়া চলা যায় না—আত্মার অভাব আলস্যভরে অনায়াসে মোচন হয় না—এবং ব্রহ্ম ক্রীড়াচ্ছলে কল্পনাবাহিত মনোরথের গম্য নহেন। সংসারে যদি বিদ্যালাভ বিত্তলাভ যশোলাভ সহজ না হয়, তবে ধর্মলাভ সত্যলাভ ব্রহ্মলাভ সহজ, এমন আশ্বাস কে দিবে এবং সে আশ্বাসে কে ভুলিবে! কোন্‌ মূঢ় বিশ্বাস করিবে যে, মন্ত্রোচ্চারণে লোহা সোনা হইয়া যাইবে। খনি-অন্বেষণের প্রয়োজন নাই? উত্তিষ্ঠত জাগ্রত! দুর্গং পথস্তৎ কবয়ো বদন্তি!

তবে ব্রহ্মলাভের চেষ্টা কি একেবারে পরিত্যাগ করিতে হইবে? তবে কি এই কথা বলিয়া মনকে বুঝাইতে হইবে যে, যাঁহারা সংসার ত্যাগ করিয়া অরণ্য-আশ্রয় গ্রহণ করেন,যাঁহাদের নিকট ভালমন্দ সুন্দরকুৎসিত অন্তরবাহিরের ভেদ একেবারে ঘুচিয়া গেছে, ব্রহ্মজ্ঞান ব্রক্ষ্মোপাসনা তাঁহাদেরই জন্য। তাই যদি হইবে তবে ব্রহ্মবাদী ঋষি ব্রহ্মচারী ব্রহ্মজিজ্ঞাসু শিষ্যকে কেন অনুশাসন করিতেছেন প্রজাতন্তুং মা ব্যবচ্ছেৎসীঃ, সন্তানসূত্র ছেদন করিবে না, অর্থাৎ গৃহাশ্রমে প্রবেশ করিবে। কেন শাস্ত্রকার বিশেষ করিয়া উপদেশ দিতেছেন ব্রহ্মনিষ্ঠো গৃহস্থঃ, স্যাৎ, গৃহস্থ ব্যক্তি ব্রহ্মনিষ্ঠ হইবেন এবং তত্ত্বজ্ঞানপরায়ণঃ, তত্ত্বজ্ঞানী হইবেন, অর্থাৎ যে নিষ্ঠার কথা কহিলেন তাহা যেন অজ্ঞাননিষ্ঠা না হয়, গৃহী যথার্থ জ্ঞানপূর্ব্বক ব্রহ্মে নিরত হইবেন এবং যদ্‌যদ্‌ কর্ম্ম প্রকুর্ব্বীত তদ্‌ব্রহ্মণি সমর্পয়েৎ, যে যে কর্ম্ম করিবেন তাহা ব্রহ্মে সমর্পণ করিবেন। অতএব শাস্ত্রের অনুশাসন এই যে, গৃহী ব্যক্তিকে কেবল ভক্তিতে নহে, জ্ঞানে—কেবল, জ্ঞানে নহে, কর্ম্মে, হৃদয়ে মনে এবং চেষ্টায়, সর্ব্বতোভাবে ব্রহ্মপরায়ণ হইতে হইবে। অতএব সংসারের মধ্যে থাকিয়া আমরা সর্বদা সর্বত্র ব্রহ্মের সত্তা উপলব্ধি করিব, অন্তরাত্মার মধ্যে তাঁহার অধিষ্ঠান অনুভব করিব এবং আমাদের সমুদয় কর্ম্ম তাঁহার সম্মুখে কৃত এবং তাঁহার উদ্দেশে সমর্পিত হইবে।

কিন্তু সর্বদা সর্বত্র তাঁহার সত্তা উপলব্ধি করিতে হইলে, চতুর্দিকের জড়বস্তুরাশিকে অপসারিত করিয়া ব্রহ্মের মধ্যেই আপনাকে সম্পূর্ণ আশ্রিত আবৃত নিমগ্ন অনুভব করিতে হইলে, তাঁহাকে সাকাররূপে কল্পনাই করা যায় না। উপনিষদে আছে, যদিদং কিঞ্চ জগৎ সর্ব্বং প্রাণ এজতি নিঃসৃতং—এই সমস্ত জগৎ সেই প্রাণ হইতে নিঃসৃত হইয়া সেই প্রাণের মধ্যে কম্পিত হইতেছে। অনন্ত প্রাণের মধ্যে সমস্ত বিশ্বচরাচর অহর্নিশি স্পন্দমান রহিয়াছে এই ভাব কি আমরা কোনপ্রকার হস্তপদবিশিষ্ট মূর্ত্তি-দ্বারা কল্পনা করিতে পারি? অথচ যদিদং কিঞ্চ জগৎ সর্ব্বং প্রাণ এজতি, এই যাহা কিছু জগৎ-সমস্ত প্রাণের মধ্যে কম্পিত হইতেছে এ কথা মনে উদয় হইবামাত্র তৎক্ষণাৎ তৃণগুল্মলতাপুষ্পপল্লব পশুপক্ষী মনুষ্য চন্দ্রসূর্য্যগ্রহনক্ষত্র, জগতের প্রত্যেক কম্পমান অণু পরমাণু, এক মহাপ্রাণের ঐক্যসমুদ্রে হিল্লোলিত দেখিতে পাই—এক মহাপ্রাণের অনন্তকম্পিত বীণাতন্ত্রী হইতে এই বিপুল বিচিত্র বিশ্বসঙ্গীত ঝঙ্কৃত শুনিতে পাই। অনন্তপ্রাণের সেই অনির্দ্দেশ্যতা অনির্ব্বচনীয়তাই আমাদের চিত্তকে প্রসারিত করিয়া দেয়। সেই জগদ্‌ব্যাপী জগদতীত প্রাণকে কোন নির্দ্দিষ্ট সঙ্কীর্ণ আকারের মধ্যে কল্পনা করিতে গেলে তখন আর তাঁহাকে আমাদের নিঃশ্বাসের মধ্যে পাই না, আমাদের চক্ষের নিমেষের মধ্যে পাই না—আমাদের রক্তের উত্তপ্ত প্রবাহ, আমাদের সর্বাঙ্গের বিচিত্র স্পর্শ,আমাদের দেহের প্রত্যেক স্পন্দিত কোষ, প্রত্যেক নিঃশ্বসিত রোমকূপের মধ্যে পাই না—আকৃতির কঠিন ব্যবধানে, মূর্ত্তির অলঙ্ঘনীয় অন্তরালে, তিনি আমাদের নিকট হইতে আমাদের অন্তর হইতে দূরে বাহিরে গিয়া পড়েন। আমার অশরীরী অভাবনীয় প্রাণ আমার আদ্যোপান্তে অখণ্ডভাবে পরিব্যাপ্ত হইয়া আছে, আমার পদাঙ্গুলির কোষাণুর সহিত আমার মস্তিষ্কের কোষাণুকে যোগযুক্ত করিয়া রাখিয়াছে—আবার আমার এই রহস্যময় প্রাণের মধ্যে সেই পরমপ্রাণ আমার শরীর কোষের প্রত্যেক স্পন্দনের সহিত সুদূরতম নক্ষত্রবর্ত্তী বাষ্পাণুর প্রত্যেক আন্দোলনকে এক অনির্ব্বচনীয় ঐক্যে এক অপূর্ব্ব অপরিমেয় ছন্দোবন্ধনে আবদ্ধ করিয়াছেন—ইহা অনুভব করিয়া এবং অনুভবের শেষ করিতে না