ধর্ম

জগৎ দিনরাত্রি অনন্তের দিকে ধাবমান হইতেছে, কিন্তু তথাপি অনন্ত হইতে অনন্ত দূরে। তাহাই দেখিয়া অধীর হইয়া আমি যদি মনে করি, জগতের হাত এড়াইতে পারিলেই আমি অনন্ত লাভ করিব, তাহা হয়ত ভ্রম হইতে পারে। অনন্তের উপরে লাফ দেওয়া ত চলে না। আমাদের সমস্ত লম্ফঝম্প এইখানেই। এই জগতের উপরেই লাফাইতেছি, এই জগতের উপরেই পড়িতেছি। আর, এই জগতের হাত হইতে অব্যাহতিই বা পাই কি করিয়া? কড়ে আঙ্গুলটা হঠাৎ যদি একদিন এমনতর স্থির করে যে, অসুস্থ শরীরের প্রান্তে বাস করিয়া আমিও অসুস্থ হইয়া পড়িতেছি, অতএব এ শরীরটা হইতে বিচ্ছিন্ন হইয়া আমি আলাদা ঘরকন্না করিগে—সে কিরূপ ছেলেমানুষের মত কথাটা হয়! সে যতই বাঁকিতে থাকুক, যতই গা-মোড়া দিক, খানিকটা পর্য্যন্ত তাহার স্বাধীনতা আছে, কিন্তু তাই বলিয়া একেবারে বিচ্ছিন্ন হইবার ক্ষমতা তাহার হাতে নাই। সমস্ত শরীরের স্বাস্থ্য তাহার সহিত লিপ্ত, এবং তাহার স্বাস্থ্য সমস্ত শরীরের সহিত লিপ্ত। জগতের এই পরমাণুরাশি হইতে একটি পরমাণু যদি কেহ সরাইতে পারিত তবে আর এ জগৎ কোথায় থাকিত! তেমনি এক জনের খেয়ালের উপরে মাত্র নির্ভর করিয়া জগতের হিসাবে একটি জীবাত্মা কম পড়িতে পারে এমন সম্ভাবনা যদি থাকে, তাহা হইলে সমস্ত জগৎটা ‘ফেল’ হইয়া যায়। কিন্তু জগতের খাতায় এরূপ বিশৃঙ্খলা এরূপ ভুল হইবার কোন সম্ভাবনা নাই। অতএব আমাদের বুঝা উচিত জগতের বিরোধী হওয়াও যা, নিজের বিরোধী হওয়াও তা, জগতের সহিত আমাদের এতই ঐক্য।

যে পথে তপন শশী আলো ধ’রে আছে,

সে পথ করিয়া তুচ্ছ, সে আলো ত্যজিয়া,

ক্ষুদ্র এই আপনার খদ্যোত-আলোকে

কেন অন্ধকারে মরি পথ খুঁজে খুঁজে!

          ...

পাখী যবে উড়ে যায় আকাশের পানে,

সেও ভাবে এনু বুঝি পৃথিবী ত্যজিয়া।

যত ওড়ে, যত ওড়ে, যত ঊর্দ্ধে যায়

কিছুতে পৃথিবী তবু পারে না ত্যজিতে

অবশেষে শ্রান্ত দেহে নীড়ে ফিরে আসে।


জগতের ধর্ম

অতএব প্রকৃতির মধ্যে যে ধ্রুব বর্তমান, স্বেচ্ছাপূর্বক সচেতনে সেই ধ্রুবের অনুগামী হওয়াই ধর্ম। ধর্ম শব্দের অর্থই দেখ না কেন। যাহাতে আবরণ বা নিবারণ করে তাহাই বর্ম, যাহাতে ধারণ করে তাহাই ধর্ম। দ্রব্যবিশেষের ধর্ম কি? যাহা অভ্যন্তরে বিরাজ করিয়া সেই দ্রব্যকে ধারণ করিয়া আছে; অর্থাৎ যাহার প্রভাবে সেই দ্রব্যের দ্রব্যত্ব খাড়া হইয়াছে। জগতের ধর্ম কি? জগৎ যে অচল নিয়মের উপর আশ্রয় করিয়া বর্তমান রহিয়াছে তাহাই জগতের ধর্ম, এবং তাহাই জগতের প্রত্যেক অণুকণার ধর্ম।