ঔপনিষদ ব্রহ্ম
উপনিষদের এই অনুশাসন।

দ্বিধাগ্রস্ত ব্যক্তি বলিবেন, উপদেশ সত্য হইতে পারে কিন্তু তাহা পালন কঠিন। অরূপ ব্রহ্মের মধ্যে দুঃখশোকের নির্বাপণ সহজ নহে। কিন্তু যদি সহজ না হয় তবে দুঃখনির্বাপণের, মুক্তিলাভের অন্য যে-কোন উপায় আরও কঠিন—কঠিন কেন, অসাধ্য। স্বতঃপ্রবাহিত অগাধ স্রোতস্বিনীর মধ্যে অবগাহনস্নান যদি কঠিন হয় তবে স্বহস্তে ক্ষুদ্রতম কূপ খনন করিয়া তাহার মধ্যে অবতরণ আরও কত কঠিন—তাই বা কেন, নিজের ক্ষুদ্র-কলস পরিমিত জল নদী হইতে বহন করিয়া স্নান করা সেও দুরূহতর। যখন ব্রহ্মকে অরূপ অনন্ত অনির্বচনীয় বলিয়া জানি তখনি তাঁহার মধ্যে সম্পূর্ণ আত্মবিসর্জন অতি সহজ নয়, তখনি তাঁহার দ্বারা পরিপূর্ণরূপে পরিবৃত হইয়া আমাদের ভয় দুঃখ শোক সর্ব্বাংশে দূর হইয়া যায়। এই জন্যই উপনিষদে আছে—

যতোবাচো নিবর্ত্তন্তে অপ্রাপ্য মনসা সহ

আনন্দং ব্রহ্মণো বিদ্বান্‌ ন বিভেতি কুতশ্চন।

মনের সহিত বাক্য যাঁহাকে না পাইয়া নিবৃত্ত হইয়া আছে সেই ব্রহ্মের আনন্দ যিনি জানিয়াছেন তিনি আর কাহা হইতেও ভয় পান না। অতএব ব্রহ্মের সেই বাক্যমনের অগোচর অনন্ত পরিপূর্ণতা উপলব্ধি করিলে তবেই আমাদের ভয় দুঃখ নিঃশেষে নিরস্ত হয়। তাঁহাকে বিশ্বজগতের অন্যান্য বস্তুর ন্যায় বাঙ্‌মনোগোচর ক্ষুদ্র করিয়া, খণ্ড করিয়া, দেখিলে আমরা সেই পরম অভয়, সেই ভূমা আনন্দ, লাভ করিতে পারি না। আমরা ত সংসারের সঙ্কীর্ণতা দ্বারা প্রতিহত, জটিলতা-দ্বারা উদ্‌ভ্রান্ত, খণ্ডতা-দ্বারা শতধা-বিক্ষিপ্ত হইয়া আছি—আমরা জানি সংসারের স্রোতাংসি সর্ব্বাণি ভয়াবহানি—সংসারের সমুদয় স্রোত ভয়াবহ—সকলেরই মধ্যে ভয়দুঃখক্লেশ জরামৃত্যুবিচ্ছেদের কারণ রহিয়াছে—অতএব আমরা যখন শান্তি চাই, অভয় চাই, আনন্দ চাই, অমৃত চাই, তখন সহজেই স্বভাবতই কাহাকে চাই? যাঁহাকে পাইলে শান্তিমত্যন্তমেতি, অত্যন্ত শান্তি পাওয়া যায়। তিনি কে? উপনিষৎ বলেন স বৃক্ষকালাকৃতিভিঃ পরোহন্যঃ—তিনি সংসার কাল এবং আকৃতি অর্থাৎ সাকার পদার্থ হইতে পরঃ, শ্রেষ্ঠ, এবং অন্যঃ অর্থাৎ ভিন্ন। যদি তিনি সংসার কাল ও সাকার পদার্থ হইতে শ্রেষ্ঠ এবং ভিন্ন না হইতেন তবে ত সংসারই আমাদের যথেষ্ট ছিল—তবে ত তাঁহাকে অন্বেষণ করিবার প্রয়োজন ছিল না।

বিশ্বস্যৈকং পরিবেষ্টিতারং জ্ঞাত্বা শিবং শান্তিমত্যন্তমেতি।

বিশ্বের একমাত্র পরিবেষ্টিতাকে জানিয়া অত্যন্ত শিব এবং অত্যন্ত শান্তি পাওয়া যায়। অতএব যাঁহারা বলেন আমরা সেই ভূমা-স্বরূপকে আয়ত্ত করিতে পারি না, সেই জন্য তাঁহাতে আমাদের স্থিতি আমাদের শান্তি নাই, তাঁহারা উপনিষৎকথিত পরম সত্য হইতে স্খলিত হইতেছেন—

যতোবাচো নিবর্ত্তন্তে অপ্রাপ্য মনসা সহ

আনন্দং ব্রহ্মণো বিদ্বান্‌ ন বিভেতি কদাচন।

বাক্য মন যাঁহাকে আয়ত্ত করিতে পারে না তাঁহাতেই আমাদের পরম আনন্দ, আমাদের অনন্ত অভয়। ঋষিরা কহিতেছেন—

যৎ বাচা নাভ্যুদিতং যেন বাক্‌ অভ্যুদ্যতে

তদেব ব্রহ্ম ত্বং বিদ্ধি নেদং যদিদমুপাসতে।

যিনি বাক্য-দ্বারা উদিত নহেন, বাক্য যাঁহার দ্বারা উদিত, তিনিই ব্রহ্ম, তাঁহাকে তুমি জান—এই যাহা কিছু উপাসনা করা যায় তাহা ব্রহ্ম নহে।

যন্মনসা ন মনুতে যেনাহুর্মনোমতম্‌

তদেব ব্রহ্ম ত্বং বিদ্ধি নেদং যদিদমুপাসতে।