ঔপনিষদ ব্রহ্ম

তদেতৎ প্রেয়ঃ পুত্রাৎ প্রেয়ো বিত্তাৎ প্রেয়োহন্যস্মাৎ সর্ব্বস্মাৎ অন্তরতরং যদয়মাত্মা—ব্রহ্মর্ষি এ কথা কোন ব্যক্তিবিশেষে বদ্ধ করিয়া বলিতেছেন না; তিনি বলিতেছেন না, যে, তিনি আমার নিকট আমার পুত্র হইতে প্রিয়, বিত্ত হইতে প্রিয়, অন্য সকল হইতে প্রিয়—তিনি বলিতেছেন আত্মার নিকটে তিনি সর্ব্বাপেক্ষা অন্তরতর—জীবাত্মামাত্রেরই নিকট তিনি পুত্র হইতে প্রিয়, বিত্ত হইতে প্রিয়, অন্য সকল হইতে প্রিয়—জীবাত্মা যখনই তাঁহাকে যথার্থরূপে উপলব্ধি করে তখনি বুঝিতে পারে তাঁহা অপেক্ষা প্রিয়তর আর কিছুই নাই।

অতএব পরমাত্মাকে যে কেবল জ্ঞানের দ্বারা জানিব তদেতৎ সত্যং, তাহা নহে; তাঁহাকে হৃদয়ের দ্বারা অনুভব করিব তদমৃতং। তাঁহাকে সকলের অপেক্ষা অধিক বলিয়া জানিব, এবং সকলের অপেক্ষা অধিক বলিয়া প্রীতি করিব। জ্ঞান ও প্রেম সমেত আত্মাকে ব্রহ্মে সমর্পণ করার সাধনাই ব্রাহ্মধর্মের সাধনা। তদ্ভাবগতেন চেতসা এই সাধনা করিতে হইবে; ইহা নীরস তত্ত্বজ্ঞান নহে, ইহা ভক্তিপ্রতিষ্ঠিত ধর্ম্ম।

উপনিষদের ঋষি যে জীবাত্মামাত্রেরই নিকট পরমাত্মাকে সর্ব্বাপেক্ষা প্রীতিজনক বলিতেছেন তাহার অর্থ কি? যদি তাহাই হইবে তবে আমরা তাঁহাকে পরিত্যাগ করিয়া ভ্রাম্যমাণ হই কেন? একটি দৃষ্টান্ত-দ্বারা ইহার অর্থ বুঝাইতে ইচ্ছা করি।

কোন রসজ্ঞ ব্যক্তি যখন বলেন কাব্যরসাবতারণায় বাল্মীকি শ্রেষ্ঠ কবি, তখন এ কথা বুঝিলে চলিবে না যে, কেবল তাঁহারই নিকট বাল্মীকির কাব্যরস সর্ব্বাপেক্ষা উপাদেয়। তিনি বলেন সকল পাঠকের পক্ষেই এই কাব্যরস সর্ব্বশ্রেষ্ঠ—ইহাই মনুষ্যপ্রকৃতি। কিন্তু কোন অশিক্ষিত গ্রাম্য জনপদ বাল্মীকির কাব্য অপেক্ষা যদি স্থানীয় কোন পাঁচালি গানে অধিক সুখ অনুভব করে তবে তাহার কারণ তাহার অজ্ঞতামাত্র। সে লোক অশিক্ষাবশতঃ বাল্মীকির কাব্য যে কি তাহা জানে না এবং সেই কাব্যের রস যেখানে, অনভিজ্ঞতাবশতঃ, সেখানে সে প্রবেশলাভ করিতে পারে না—কিন্তু তাহার অশিক্ষাবাধা দূর করিয়া দিবারাত্র যখনি সে বাল্মীকির কাব্যের যথার্থ পরিচয় পাইবে তখনি সে স্বভাবতই মানবপ্রকৃতির নিজগুণেই গ্রাম্য পাঁচালি অপেক্ষা বাল্মীকির কাব্যকে রমণীয় বলিয়া জ্ঞান করিবে। তেমনি যে ঋষি ব্রহ্মের অমৃতরস আস্বাদন করিয়াছেন, যিনি তাঁহাকে পৃথিবীর অন্য সকল হইতেই প্রিয় বলিয়া জানিয়াছেন, তিনি ইহা সহজেই বুঝিয়াছেন যে, ব্রহ্ম স্বভাবতই আত্মার পক্ষে সর্ব্বাপেক্ষা প্রীতিদায়ক—ব্রহ্মের প্রকৃত পরিচয় পাইবামাত্র আত্মা স্বভাবতই তাঁহাকে পুত্র বিত্ত ও অন্য সকল হইতেই প্রিয়তম বলিয়া বরণ করে।

ব্রহ্মের সহিত এই পরিচয় যে কেবল আত্মার আনন্দ-সাধনের জন্য তাহা নহে, সংসারযাত্রার পক্ষেও তাহা না হইলে নয়। ব্রহ্মকে ব্যক্তি বৃহৎ বলিয়া না জানিয়া সংসারকেই বৃহৎ বলিয়া জানে, সংসারযাত্রা সে সহজে নির্ব্বাহ করিতে পারে না-সংসার তাহাকে রাক্ষসের ন্যায় গ্রাস করিয়া নিজের জঠরানলে দগ্ধ করিতে থাকে। এই জন্য ঈশোপনিষদে লিখিত হইয়াছে—

ঈশাবাস্যমিদং সর্ব্বং যৎকিঞ্চ জগত্যাং জগৎ

ঈশ্বরের দ্বারা এই জগতের সমস্ত যাহা কিছু আচ্ছন্ন জানিবে এবং—

তেন ত্যক্তেন ভুঞ্জীথা মা গৃধঃ কস্যস্বিদ্ধনং

তাঁহার দ্বারা যাহা দত্ত, যাহা কিছু তিনি দিতেছেন, তাহাই ভোগ করিবে, পরের ধনে লোভ করিবে না।

সংসারযাত্রার এই মন্ত্র। ঈশ্বরকে সর্ব্বত্র দর্শন করিবে, ঈশ্বরের দত্ত আনন্দ-উপকরণ উপভোগ করিবে, লোভের দ্বারা পরকে পীড়িত করিবে না।

যে ব্যক্তি ঈশ্বরের দ্বারা সমস্ত সংসারকে আচ্ছন্ন দেখে সংসার তাহার নিকট একমাত্র মুখ্যবস্তু নহে। সে যাহা ভোগ করে তাহা ঈশ্বরের দান বলিয়া ভোগ করে—সেই ভোগে সে ধর্ম্মের সীমা লঙ্ঘন করে না, নিজের ভোগমত্ততায় পরকে পীড়া দেয় না—সংসারকে