রচনাপ্রকাশ
এ-পর্যন্ত যাহা কিছু লিখিতেছিলাম তাহার প্রচার আপনা-আপনির মধ্যেই বদ্ধ ছিল। এমন সময় জ্ঞানাঙ্কুর নামে একটি কাগজ বাহির হইল। কাগজের নামের উপযুক্ত একটি অঙ্কুরোগত কবিও কাগজের কর্তৃপক্ষেরা সংগ্রহ করিলেন। আমার সমস্ত পদ্যপ্রলাপ নির্বিচারে তাঁহারা বাহির করিতে শুরু করিয়াছিলেন। কালের দরবারে আমার সুকৃতি দুষ্কৃতি বিচারের সময় কোনোদিন্ তাহাদের তলব পড়িবে, এবং কোন্ উৎসাহী পেয়াদা তাহাদিগকে বিস্মৃত কাগজের অন্দরমহল হইতে নির্লজ্জভাবে লোকসমাজে টানিয়া বাহির করিয়া আনিবে, জেনানার দোহাই মানিবে না, এ ভয় আমার মনের মধ্যে আছে।

প্রথম যে-গদ্যপ্রবন্ধ লিখি তাহাও এই তাহাও এই জ্ঞানাঙ্কুরেই বাহির হয়। তাহা গ্রন্থ-সমালোচনা। তাহার একটু ইতিহাস আছে।

তখন ভুবনমোহিনীপ্রতিভা নামে একটি কবিতার বই বাহির হইয়াছিল। বই খানি ভুবনমোহিনী নামধারিণী কোনো মহিলার লেখা বলিয়া সাধারণের ধারণা জন্মিয়া গিয়াছিল। সাধারণী কাগজে অক্ষয় সরকার মহাশয় এবং এডুকেশন গেজেটে ভূদেববাবু এই কবির অভ্যুদয়কে প্রবল জয়বাদ্যের সহিত ঘোষণা করিতেছিলেন।

তখনকার কালের আমার একটি বন্ধু আছেন— তাঁহার বয়স আমার চেয়ে বড়ো। তিনি আমাকে মাঝে মাঝে ‘ভুবনমোহিনী’ সই-করা চিঠি আনিয়া দেখাইতেন। ‘ভুবনমোহিনী’ কবিতায় ইনি মুগ্ধ হইয়া পড়িয়াছিলেন এবং ‘ভুবনমোহিনী’ ঠিকানায় প্রায় তিনি কাপড়টা বইটা ভক্তি-উপহাররূপে পাঠাইয়া দিতেন।

এই কবিতাগুলির স্থানে স্থানে ভাবে ও ভাষায় এমন অসংযম ছিল যে, এগুলিকে স্ত্রীলোকের লেখা বলিয়া মনে করিতে আমার ভালো লাগিত না। চিঠিগুলি দেখিয়াও পত্রলেখককে স্ত্রীজাতীয় বলিয়া মনে করা অসম্ভব হইল। কিন্তু আমার সংশয়ে বন্ধুর নিষ্ঠা চলিল না, তাঁহার প্রতিমাপূজা চলিতে লাগিল।

আমি তখন ভুবনমোহিনীপ্রতিভা, দুঃখসঙ্গিনী ও অবসরসরোজিনী বই তিনখানি অবলম্বন করিয়া জ্ঞানাঙ্কুরে এক সমালোচনা লিখিলাম

খুব ঘটা করিয়া লিখিয়াছিলাম। খণ্ডকাব্যেরই বা লক্ষণ কী, গীতিকাব্যেরই বা লক্ষণ কী, তাহা অপূর্ব বিচক্ষণতার সহিত আলোচনা করিয়াছিলাম। সুবিধার কথা এই ছিল, ছাপার অক্ষর সবগুলিই সমান নির্বিকার, তাহার মুখ দেখিয়া কিছুমাত্র চিনিবার জো নাই, লেখকটি কেমন, তাহার বিদ্যাবুদ্ধির দৌড় কত। আমার বন্ধু অত্যন্ত উত্তেজিত হইয়া আসিয়া কহিলেন, “একজন বি. এ. তোমার এই লেখার জবাব লিখিতেছেন।” বি. এ. শুনিয়া আমার আর বাক্যস্ফূর্তি হইল না। বি. এ.! শিশুকাল সত্য যেদিন বারান্দা হইতে পুলিসম্যানকে ডাকিয়াছিল সেদিন আমার যে-দশা আজও আমার সেইরূপ। আমি চোখের সামনে স্পষ্ট দেখিতে লাগিলাম খণ্ডকাব্য গীতিকাব্য সম্বন্ধে আমি যে-কীর্তিস্তম্ভ খাড়া করিয়া তুলিয়াছি বড়ো বড়ো কোটেশনের নির্মম আঘাতে তাহা সমস্ত ধুলিসাৎ হইয়াছে এবং পাঠকসমাজে আমার মুখ দেখাইবার পথ একেবারে বন্ধ। ‘কুক্ষণে জনম তোর, রে সমালোচনা!’ উদ্‌বেগে দিনের পর দিন কাটিতে লাগিল। কিন্তু বি. এ. সমালোচক বাল্যকালের পুলিসম্যান্‌টির মতোই দেখা দিলেন না।


১ ‘ঞ্জানাঙ্কুর ও প্রতিবিম্ব’ নামক মাসিকপত্র, প্রকাশক যোগেশচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়, কলিকাতা ১২৮২। ‘ঞ্জানাঙ্কুর’ নামে রাজসাহী হইতে শ্রীকৃষ্ণ দাস –এর সম্পাদনায় প্রথম প্রকাশ অগ্রহায়ণ ১২৭৯।

২ ‘বনফুল’ ‘প্রলাপ’ (১২৮২-৮৩)

৩ নবীনচন্দ্র মুখোপাধ্যায় (১৮৫৩-১৯২২) –প্রণীত। দ্র উক্ত গ্রন্থের দ্বিতীয় সংস্করণ, ১২৮৬

৪ প্রকাশ, কার্তিক ১২৮০

৫ ভূদেব মুখোপাধ্যায়। গেজেটের সম্পাদক ১২৬৮

৬ ‘ভুবনমোহিনীপ্রতিভা, অবসরসরোজিনী ও দুঃখসঙ্গিনী’— ঞ্জানাঙ্কুর ও প্রতিবিম্ব, কার্তিক ১২৮৩