মুক্তির উপায়

ফকির। কা তব কান্তা। কোন্‌ কান্তা হ্যায়।

হৈমবতা। হিন্দুস্থানী ধরেছ? বাংলায় বলো।

ফকির। বলি, কাঁদছে কে।

হৈমবতী। তোমারই মেয়ে মিন্তু।

ফকির। হায় রে, একেই বলে সংসার। কাঁদিয়ে ভাসিয়ে দিলে।

হৈমবতী। কাকে বলে সংসার।

ফকির। তোমাকে।

হৈমবতী। আর, তুমি কী! মুক্তির জাহাজ আমার! তোমরা বাঁধ না, আমরাই বাঁধি!

ফকির। গুরু বলেছেন, বাঁধন তোমাদেরই হাতে।

হৈমবতী। আমি তোমাকে যদি বেঁধে থাকি সাত পাকে, তোমার গুরু বেঁধেছেন সাতান্ন পাকে।

ফকির। মেয়েমানুষ— কী বুঝবে তুমি তত্ত্বকথা! কামিনী কাঞ্চন—

হৈম। দেখো, ভণ্ডামি কোরো না। কাঞ্চনের দাম তোমার গুরুজি কতখানি বোঝেন সে আমাকে হাড়ে হাড়ে বুঝিয়ে দিয়েছেন। আর, কামিনীর কথা বলছ! ঐ মূর্খ কামিনীগুলোই পায়ের ধুলো নিয়ে পায়ে কাঞ্চন যদি না ঢালত তা হলে তোমার গুরুজির পেট অত মোটা হত না। একটা খবর তোমাকে দিয়ে রাখি। এ বাড়ি থেকে একটা মায়া তোমার কাটবে। কাঞ্চনের বাঁধন খসল তোমার। শ্বশুরমশায় আমাকে দিব্যি গালিয়ে নিয়েছেন, আমার মাসহারা থেকে তোমাকে এক পয়সাও আর দিত পারব না।

পুষ্পর প্রবেশ

পুষ্প। ফকিরদা! মানে কী। তোমার শোবার ঘর থেকে পাওয়া গেল মাণ্ডূক্যোপনিষৎ! অনিদ্রার পাঁচন না কি!

ফকির। (ঈষৎ হেসে) তোমরা কী বুঝবে— মেয়েমানুষ!

পুষ্প। কৃপা করে বুঝিয়ে দিতে দোষ কী!

ফকির হাস্যমুখে নীরব

হৈম। কী জানি ভাই, ওখানা উনি বালিশের নীচে রেখে রাত্তিরে ঘুমোন।

পুষ্প। বেদমন্ত্রগুলোকে তলিয়ে দেন ঘুমের তলায়। এ বই পড়তে গেলে যে তোমাকে ফিরে যেতে হবে সাতজন্ম পূর্বে।

ফকির। গুরুকৃপায় আমাকে পড়তে হয় না।

পুষ্প। ঘুমিয়ে পড়তে হয়।

ফকির। এই পুঁথি হাতে তুলে নিয়ে তিনি এর পাতায় পাতায় ফুঁ দিয়ে দিয়েছেন, জ্বলে উঠেছে এর আলো, মলাট ফুঁড়ে জ্যেতি বেরতে থাকে অক্ষরের ফাঁকে ফাঁকে, ঢুকতে থাকে সুষুম্না নাড়ির পাকে পাকে।

পুষ্প। সেজন্যে ঘুমের দরকার?

ফকির। খুবই। আমি স্বয়ং দেখেছি গুরুজিকে, দুপুরবেলা আহারের পর ভগবদগীতা পেটের উপর নিয়ে চিৎ হয়ে পড়ে আছেন বিছানায়— গভীর নিদ্রা। বারণ করে দিয়েছেন সাধনায় ব্যাঘাত করতে। তিনি বলেন, ইড়াপিঙ্গলার মধ্য দিয়ে শ্লোকগুলো অন্তরাত্মায় প্রবেশ করতে থাকে, তার আওয়াজ স্পষ্ট শোনা যায়। অবিশ্বাসীরা বলে, নাক ডাকে। তিনি হাসেন; বলেন, মূঢ়দের নাক ডাকে, ইড়াপিঙ্গলা ডাকে জ্ঞানীদের— নাসারন্ধ্র আর ব্রহ্মরন্ধ্র ঠিক এক রাস্তায়, যেন চিৎপুর আর চৌরঙ্গী।