চণ্ডালিকা

প্রকৃতি। চিনতে পার নি এতদিন। যিনি চিনেছেন তিনি চেনাবেন। তাই আছি তাকিয়ে। রাজদুয়ারে দুপুরের ঘণ্টা বাজে, মেয়েরা জল নিয়ে যায় ঘরে, শঙ্ঘচিল একলা ওড়ে দূর আকাশে, আমার ঘট নিয়ে এসে বসি কুয়োতলায় পথের ধারে।

মা। কার জন্যে।

প্রকৃতি। পথিকের জন্যে।

মা। তোর কাছে কোন্‌ পথিক আসবে, পাগলি!

প্রকৃতি। সেই এক পথিক, মা, সেই এক পথিক। তাঁর মধ্যে আছে বিশ্বের সকল পথের সব পথিক। দিনের পর দিন চলে যায়, এলেন না তো। কোনো কথা না ব’লে তবু কথা দিয়ে গিয়েছিলেন, কিন্তু রাখলেন না কেন কথা। আমার মন যে হল মরুভূমির মতো; ধূ ধূ করে সমস্ত দিন, হু হু করে তপ্ত হাওয়া, সে যে পারছে না জল দিতে। কেউ এসে চাইলে না।

গান

       চক্ষে আমার তৃষ্ণা, ওগো

         তৃষ্ণা আমার বক্ষ জুড়ে।

আমি     বৃষ্টিবিহীন বৈশাখী দিন,

         সন্তাপে প্রাণ যায় যে পুড়ে।

     ঝড় উঠেছে তপ্ত হাওয়ায়,

     মনকে সুদূর শূন্যে ধাওয়ায়,

           অবগুণ্ঠন যায় যে উড়ে।

     যে-ফুল কানন করত আলো

     কালো হয়ে সে শুকাল।

        ঝরনারে কে দিল বাধা—

        তাপের প্রতাপে বাঁধা

           দুঃখের শিখরচূড়ে॥

মা। তোর আজকেকার কথা কিছু বুঝতে পারছি নে, তোকে কী নেশা লেগেছে কী জানি। কী চাস, আমাকে সাদা ক’রে বল্‌।

প্রকৃতি। আমি চাই তাঁকে। তিনি আচমকা এসে আমাকে জানিয়ে গেলেন, আমার সেবাও চলবে বিধাতার সংসারে, এত বড়ো আশ্চর্য কথা! সেবিকা আমি, এই কথাটি নিন তুলে ধুলোর থেকে তাঁর বুকের কাছে, এই ধুতরো ফুলটাকে।

মা। মনে রাখিস, প্রকৃতি, ওদের কথা কানেই শোনবার, কাজে খাটাবার নয়। অদৃষ্টদোষে যে-কুলে জন্মেছিস তার কাদার বেড়া ভাঙতে পারে এমন লোহার খোন্‌তাও নেই কোনখানে। অশুচি তুই, তোর অশুচি হাওয়া ছড়িয়ে বেড়াস নে বাইরে, যেখানে আছিস সেইখানটুকুতেই থাক্‌ সাবধানে। এই জায়গাটুকুর বাইরে সর্বত্রই তোর অপরাধ।

প্রকৃতি।                                                        গান

ফুল বলে, ধন্য আমি মাটির ’পরে,

      দেবতা ওগো, তোমার সেবা আমার ঘরে।