লেখা কুমারী ও ছাপা সুন্দরী
গুটিকতক কবিতা লেখা ছিল, অনেক দিন ধরিয়া খাতায় পড়িয়াছিল, যতই দিন যাইতে লাগিল, ততই সে লেখাগুলিকে ভালো বলিয়া জ্ঞান হইতে লাগিল। অবশেষে সম্প্রতি সেগুলি ছাপা হইয়া গেছে। ধারণা ছিল, নিজের লেখা ছাপার অক্ষরে পড়িতে বুঝি বড়োই আনন্দ হইবে।

কিন্তু কই, তাহা তো হইল না! আজ সমস্তদিন ধরিয়া মুদ্রাযন্ত্রের লৌহগর্ভ হইতে সদ্যপ্রসূত বইখানি হাতে লইয়া এ-পাত ও-পাত করিতেছি, কিছুই ভালো লাগিতেছে না।

লেখাগুলির পানে চাহিয়া চাহিয়া আমার প্রাণ বলিতেছে ‘বাছারা, আজ তোদের এমনতর দেখিতেছি কেন? অক্ষরগুলি মাথায় মাথায় সমান, কাষ্ঠের মতো খাড়া দাঁড়াইয়া আছে! একটু কিছুই এদিক-ওদিক হয় নাই। লাইনগুলি সমান, দুই ধারে মার্জিন, উপরে পাতার সংখ্যা। এ-সব তো সিপাহিদের মতো ছোরা-ছুরি-সঙ্গিন ওচানো সার-বাঁধা পোশাক-পরা অক্ষর। এ-সব তো সীসা ঢালা ছাঁচের অক্ষর, যেখানে যত বই দেখি, সকলই তো এইরকম অক্ষরের দেখিতে পাই! আমার সে বাঁকাচেরা সরু-মোটা অক্ষরগুলি কী হইল? কোনোটা-বা শুইয়া, কোনোটা-বা বসিয়া, কোনোটা উপরে, কোনোটা-বা নীচে। সেগুলি তো এমনতর কোণ-ওয়ালা খোঁচা- খোঁচা রেখা-রেখা খাড়া-খাড়া অক্ষর নহে; গোল, মোলায়েম, আঁকাবাঁকা, জড়ানো, অক্ষর। প্রত্যেক অক্ষরগুলি স্ব-স্ব প্রধান নয়। সকলেই সকলের গায়ে পড়িয়া, গলা ধরিয়া, হাতে হাতে জড়াইয়া ঘেঁসাঘেঁসি করিয়া থাকে। তাহাদরে পানে চাহিলে ভাবের কোট চেহারা দেখিতে পাওয়া যায়, ভাবটিকে রক্তমাংসের বলিয়া মনে হয়। সে লেখা আমার প্রিয়জনেরা সকলেই ভালো করিয়া জানে,সে লেখা পথের প্রান্তে কুড়াইয়া পাইলেও তাহারা আমার বলিয়া চিনিতে পারে, সে লেখা বিদেশে পাইলে তাহাদের মন আনন্দে নাচিয়া উঠে। তাহারা সে লেখার মধ্যে আমার মুখ দেখিতে পায়, আমার স্পর্শ অনুভব করে, আমার কণ্ঠধ্বনি শুনিতে পায়। সে আমার চিরপরিচিতগণ গেল কোথায়? আর এরা কে রে! এরা তো সব দাসের জাতি। সীসার কঠিন শৃঙ্খলে বাঁধা, ভাবশূন্য মুখে খাড়া রহিয়াছে, টাকার লোভে কাজ করিতেছে। ইহাদের সহিত আমার ভাবের নাড়ির টান নাই, ইহারা আমার ভাবগুলির প্রতি মমতার দৃষ্টিতে চায় না। আমার কাজ সমাধা করিয়া দিয়াই আবার তখনই হয়তো আমার সমালোচকের কাজ করিতে যায়! এ-সকল হৃদয়হীন দাসগুলিকে দেখিয়া আমার মন খারাপ হইয়া গেছে।

ওরে, তোদের সে কাটাকুটিগুলি গেল কোথায়! তোদের সে কালির দাগগুলো যে দেখি না! পূর্বে তো তোদের এমনতর নিখুঁত ভদ্রলোকটির মতো চেহারা ছিল না। ঘরের ছেলের মতো গায়ে ধুলা-কাদা মাখা, কাপড়ে দাগ, সেই তো তোকে শোভা পাইত। আর আজ সহসা তোদের এমনতর পরিপাটি বিজ্ঞভাব দেখিলে যে জেঠামি বলিয়া মনে হয়। বাপু, তোরা কি জানাইতে চাস তোদের মধ্যে একেবারে বানান ভুল ছিল না? কোথাও দন্ত্য সয়ের জায়গায় তালব্য শ ছিল না? আজ বড়ো লজ্জা বোধ হইল? পাড়াগেঁয়ে ছেলে শহরে আসিয়া যেমন প্রাণপণে শহুরে উচ্চারণে কথা কহিতে চায় তোদেরও কি সেই দশা হইল? তোরা আমার পাড়াগেঁয়ে ছেলে, তোদের উচ্চারণ শুনিয়া শহরশুদ্ধ লোকের পেট ফাটিয়া যাইবে, কিন্তু বাপের কানে অমন মিষ্ট আর কী আছে! তোদের সে বানান-ভুলগুলি আমার পরিচিত হইয়া গেছে, তোদের মুখের সহিত, আমার স্নেহের সহিত তাহারা জড়িত হইয়া গেছে। তাহাদের না দেখিলে আমি ভালো থাকি না। তাহাদের না দেখিলে তোদের যে ভাবে লিখিয়াছিলাম, সে ভাব আমার ঠিক মনে পড়ে না।

আগে তোদের আদর কম ছিল? জলটি লাগিলে তোদের অক্ষর মুছিয়া যাইত, একটি পাতা দৈবাৎ ছিঁড়িয়া বা হারাইয়া গেলে হাজার টাকা দিলেও আর সেটি পাওয়া যাইত না। ছাপার অক্ষর ধোয় না মোছে না, একটা বই হারাইয়া গেলে একটা টাকা দিলেই