নৌকাডুবি
আলিপুরে প্র্যাকটিস করিবেন। মানুষ তো আর অনন্তকাল শোক করিয়া কাটাইতে পারে না, বিশেষত তাঁহার অল্প বয়স। চক্রবর্তীমহাশয়, চলুন, শহরে একবার ভালো করিয়া খোঁজ করিয়া দেখা যাক।”

অন্নদাবাবু জিজ্ঞাসা করিলেন, “অক্ষয়, তুমি তো এইখানেই আসিতেছ?”

অক্ষয় কহিল, “ঠিক বলিতে পারি না। আমার মনটা বড়োই খারাপ হইয়া আছে অন্নদাবাবু। যত দিন কাশীতে আছি, আমাকে এই খোঁজেই থাকিতে হইবে। বলেন কী, ভদ্রলোকের মেয়ে, যদিই তিনি মনের দুঃখে ঘর ছাড়িয়া চলিয়া আসিয়া থাকেন, তবে আজ কী বিপদেই পড়িয়াছেন বলুন দেখি। রমেশবাবু দিব্য নিশ্চিন্ত হইয়া থাকিতে পারেন, কিন্তু আমি তো পারি না।”

খুড়াকে সঙ্গে লইয়া অক্ষয় চলিয়া গেল।

অন্নদাবাবু অত্যন্ত উদ্‌‍বিগ্ন হইয়া একবার হেমনলিনীর মুখের দিকে চাহিয়া দেখিলেন। হেমনলিনী প্রাণপণে নিজেকে সংযত করিয়া বসিয়াছিল। সে জানিত, তাহার পিতা মনে মনে তাহার জন্য আশঙ্কা অনুভব করিতেছেন।

হেমনলিনী কহিল, “বাবা, আজ একবার ডাক্তারকে দিয়া তোমার শরীরটা ভালো করিয়া পরীক্ষা করাও। একটুকুতেই তোমার স্বাস্থ্য নষ্ট হইয়া যায়, ইহার একটা প্রতিকার করা উচিত।”

অন্নদাবাবু মনে মনে অত্যন্ত আরাম অনুভব করিলেন। রমেশকে লইয়া এতবড়ো আলোচনাটার পর হেমনলিনী যে তাঁহার পীড়া লইয়া উদ্‌‍বেগ প্রকাশ করিল, ইহাতে তাঁহার মনের মধ্য হইতে একটা ভার নামিয়া গেল। অন্য সময় হইলে তিনি নিজের পীড়ার প্রসঙ্গ উড়াইয়া দিতে চেষ্টা করিতেন; আজ কহিলেন, “সে তো বেশ কথা। শরীরটা নাহয় পরীক্ষা করানোই যাক। তাহা হইলে আজ নাহয় একবার নলিনাক্ষকে ডাকিতে পাঠাই। কী বল?”

নলিনাক্ষ সম্বন্ধে হেমনলিনী একটুখানি সংকোচে পড়িয়া গেছে। পিতার সম্মুখে তাহার সহিত পূর্বের ন্যায় সহজভাবে মেলা তাহার পক্ষে কঠিন হইবে, তবু সে বলিল, “সে’ই ভালো, তাঁহাকে ডাকিতে লোক পাঠাইয়া দিই।”

অন্নদাবাবু হেমের অবিচলিত ভাব দেখিয়া ক্রমে সাহস পাইয়া কহিলেন, “হেম, রমেশের এই সমস্ত কাণ্ড— ”

হেমনলিনী তৎক্ষণাৎ তাঁহাকে বাধা দিয়া কহিল, “বাবা, রৌদ্রের ঝাঁজ বাড়িয়া উঠিয়াছে— চলো, এখন ঘরে চলো।” বলিয়া তাঁহাকে আপত্তি করিবার অবসর না দিয়া হাত ধরিয়া ঘরে টানিয়া লইয়া গেল। সেখানে তাঁহাকে আরাম-কেদারায় বসাইয়া তাঁহার গায়ে বেশ করিয়া গরম কাপড় জড়াইয়া দিয়া তাঁহার হাতে একখানি খবরের কাগজ দিল এবং চশমার খাপ হইতে চশমাটি বাহির করিয়া নিজে তাঁহার চোখে পরাইয়া দিয়া কহিল, “কাগজ পড়ো, আমি আসিতেছি।”

অন্নদাবাবু সুবাধ্য বালকের মতো হেমনলিনীর আদেশ পালন করিতে চেষ্টা করিলেন, কিন্তু কোনোমতেই মনোনিবেশ করিতে পারিলেন না। হেমনলিনীর জন্য তাঁহার মন উৎকণ্ঠিত হইয়া উঠিতে লাগিল। অবশেষে এক সময় কাগজ রাখিয়া হেমের খোঁজ করিতে গেলেন; দেখিলেন, সেই প্রাতে অসময়ে তাহার ঘরের দরজা বন্ধ।

কিছু না বলিয়া অন্নদাবাবু বারান্দায় পায়চারি করিয়া বেড়াইতে লাগিলেন। অনেকক্ষণ পরে আবার একবার হেমনলিনীকে খুঁজিতে গিয়া দেখিলেন, তখনো তাহার দরজা বন্ধ রহিয়াছে। তখন শ্রান্ত অন্নদাবাবু ধপ্‌ করিয়া তাঁহার চৌকিটার উপর বসিয়া পড়িয়া মুহুর্মুহু মাথার চুলগুলাকে করসঞ্চালনদ্বারা উচ্ছৃঙ্খল করিয়া তুলিতে লাগিলেন।

নলিনাক্ষ আসিয়া অন্নদাবাবুকে পরীক্ষা করিয়া দেখিল এবং যথাকর্তব্য বলিয়া দিল এবং হেমকে জিজ্ঞাসা করিল, “অন্নদাবাবুর মনে কি বিশেষ কোনো উদ্‌‍বেগ আছে?”

হেম কহিল, “তা থাকিতে পারে।”

নলিনাক্ষ কহিল, “যদি সম্ভব হয়, উঁহার মনের সম্পূর্ণ বিশ্রাম আবশ্যক। আমার মার সম্বন্ধেও ঐ এক মুশকিলে পড়িয়াছি;