নৌকাডুবি
ডাক-যোগে পাইয়া আশ্চর্য হইয়া যাইত। তাঁহার একটি বড়ো আবলুস কাঠের কালো সিন্ধুকের মধ্যে এইরূপ অনাবশ্যক সুন্দর শৌখিন জিনিসপত্র, রেশমের কাপড়-চোপড় অনেক সঞ্চিত ছিল। তিনি মনে মনে ঠিক করিয়া রাখিয়াছিলেন, নলিনের বউ যখন আসিবে তখন এগুলি সমস্ত তাহারই হইবে। নলিনের একটি পরমাসুন্দরী বালিকাবধূ তিনি মনে মনে কল্পনা করিয়া রাখিয়াছিলেন— সে তাঁহার ঘর উজ্জ্বল করিয়া খেলিয়া বেড়াইতেছে, তাহাকে তিনি সাজাইতেছেন-পরাইতেছেন, এই সুখচিন্তায় তাঁহার অনেক দিনের অনেক অবসর কাটিয়াছে।

তিনি নিজে তপস্বিনীর মতো ছিলেন; স্নানাহ্নিক-পূজায় প্রায় দিন কাটিয়া গেলে এক বেলা ফল দুধ মিষ্ট খাইয়া থাকিতেন; কিন্তু নিয়মসংযমে নলিনাক্ষের এতটা নিষ্ঠা তাঁহার ঠিক মনের মধ্যে ভালো লাগিত না। তিনি বলিতেন, ‘পুরুষমানুষের আবার অত আচার-বিচারের বাড়াবাড়ি কেন?’ পুরুষমানুষদিগকে তিনি বৃহৎবালকদের মতো মনে করিতেন; খাওয়াদাওয়া-চালচলনে উহাদের পরিমাণবোধ বা কর্তব্যবোধ না থাকিলে সেটা যেন তিনি সস্নেহ প্রশ্রয়বুদ্ধির সহিত সংগত মনে করিতেন, ক্ষমার সহিত বলিতেন, ‘পুরুষমানুষ কঠোরতা করিতে পারিবে কেন!’ অবশ্য, ধর্ম সকলকেই রক্ষা করিতে হইবে, কিন্তু আচার পুরুষমানুষের জন্য নহে, ইহাই তিনি মনে মনে ঠিক করিয়াছিলেন। নলিনাক্ষ যদি অন্যান্য সাধারণ পুরুষের মতো কিঞ্চিৎ পরিমাণে অবিবেচক ও স্বেচ্ছাচারী হইত, সতর্কতার মধ্যে কেবলমাত্র তাঁহার পূজার ঘরে প্রবেশ এবং অসময়ে তাঁহাকে স্পর্শ করাটুকু বাঁচাইয়া চলিত, তাহা হইলে তিনি খুশিই হইতেন।

ব্যামো হইতে যখন সারিয়া উঠিলেন ক্ষেমংকরী দেখিলেন, হেমনলিনী নলিনাক্ষের উপদেশ-অনুসারে নানাপ্রকার নিয়মপালনে প্রবৃত্ত হইয়াছে, এমন-কি, বৃদ্ধ অন্নদাবাবুও নলিনাক্ষের সকল কথা প্রবীণ গুরুবাক্যের মতো বিশেষ শ্রদ্ধা ও ভক্তির সহিত অবধান করিয়া শুনিতেছেন।

ইহাতে ক্ষেমংকরীর অত্যন্ত কৌতুক বোধ হইল। তিনি একদিন হেমনলিনীকে ডাকিয়া হাসিয়া কহিলেন, “মা, তোমরা দেখিতেছি, নলিনকে আরো খ্যাপাইয়া তুলিবে। ওর ও-সমস্ত পাগলামির কথা তোমরা শোন কেন? তোমরা সাজগোজ করিয়া, হাসিয়া-খেলিয়া আমোদ-আহ্লাদে বেড়াইবে; তোমাদের কি এখন সাধন করিবার বয়স? যদি বল ‘তুমি কেন বরাবর এই-সব লইয়া আছ’, তার একটু কথা আছে। আমার বাপ-মা বড়ো নিষ্ঠাবান ছিলেন। ছেলেবেলা হইতে আমরা ভাইবোনেরা এই-সকল শিক্ষার মধ্যেই মানুষ হইয়া উঠিয়াছি। এ যদি আমরা ছাড়ি তো আমাদের দ্বিতীয় কোনো আশ্রয় থাকে না। কিন্তু তোমরা তো সেরকম নও; তোমাদের শিক্ষাদীক্ষা তো সমস্তই আমি জানি। তোমরা এ যা-কিছু করিতেছ এ কেবল জোর করিয়া করিতেছ; তাহাতে লাভ কী মা? যে যাহা পাইয়াছে সে তাহাই ভালো করিয়া রক্ষা করিয়া চলুক, আমি তো এই বলি। না না, ও-সব কিছু নয়, ও-সমস্ত ছাড়ো। তোমাদের আবার নিরামিষ খাওয়া কী, যোগ-তপই বা কিসের! আর নলিনই বা এতবড়ো গুরু হইয়া উঠিল কবে? ও এ-সকলের কী জানে? ও তো সেদিন পর্যন্ত যা-খুশি-তাই করিয়া বেড়াইয়াছে, শাস্ত্রের কথা শুনিলে একেবারে মারমূর্তি ধরিত। আমাকেই খুশি করিবার জন্য এই-সমস্ত আরম্ভ করিল, শেষকালে দেখিতেছি কোন্‌দিন পুরা সন্ন্যাসী হইয়া বাহির হইবে। আমি ওকে বার বার করিয়া বলি, ‘ছেলেবেলা হইতে তোর যা বিশ্বাস ছিল তুই তাই লইয়াই থাক্‌; সে তো মন্দ কিছু নয়, আমি তাহাতে সন্তুষ্ট বৈ অসন্তুষ্ট হইব না।’ শুনিয়া নলিন হাসে; ঐ ওর একটি স্বভাব, সকল কথাই চুপ করিয়া শুনিয়া যায়, গাল দিলেও উত্তর করে না।”

অপরাহ্নে পাঁচটার পর হেমনলিনীর চুল বাঁধিয়া দিতে দিতে এই-সমস্ত আলোচনা চলিত। হেমের খোঁপা-বাঁধা ক্ষেমংকরীর পছন্দ হইত না। তিনি বলিতেন, “তুমি বুঝি মনে কর মা, আমি নিতান্তই সেকেলে, এখনকার কালের ফ্যাশান কিছুই জানি না। কিন্তু আমি যতরকম চুল-বাঁধা জানি এত তোমরাও জান না বাছা। একটি বেশ ভালো মেম পাইয়াছিলাম, সে আমাকে সেলাই শিখাইতে আসিত, সেইসঙ্গে কতরকম চুল-বাঁধাও শিখিয়াছিলাম। সে চলিয়া গেলে আবার আমাকে স্নান করিয়া কাপড় ছাড়িতে