নৌকাডুবি
না।

অক্ষয় বলিল, “ও” বলিয়া আপন কর্মে মন দিল।

রমেশ বাসায় ফিরিয়া আসিয়া ভাবিতে লাগিল, ‘অদৃষ্ট এ কী বিষম কৌতুকে প্রবৃত্ত হইয়াছে। এক দিকে
আমার সঙ্গে কমলার ও অন্য দিকে নলিনাক্ষের সঙ্গে হেমনলিনীর এই মিলন, এ যে একেবারে উপন্যাসের মতো— সেও কুলিখিত উপন্যাস। এমনতরো ঠিক উলটাপালটা মিল করিয়া দেওয়া অদৃষ্টেরই মতো বেপরোয়া রচয়িতার পক্ষেই সম্ভব— সংসারে সে এমন অদ্ভুত কাণ্ড ঘটায় যাহা ভীরু লেখক কাল্পনিক উপাখ্যানে লিখিতে সাহস করে না।’ কিন্তু রমেশ ভাবিল, এবার সে যখন তাহার জীবনের সমস্যাজাল হইতে মুক্ত হইয়াছে, তখন খুব সম্ভব, অদৃষ্ট এই জটিল উপন্যাসের শেষ অধ্যায়ে রমেশের পক্ষে নিদারুণ উপসংহার লিখিবে না।

যোগেন্দ্র বিশাইপুর জমিদার-বাড়ির নিকটবর্তী একটি একতলা বাড়িতে বাসা পাইয়াছিল; সেখানে রবিবার সকালে খবরের কাগজ পড়িতেছিল এমন সময় বাজারের একটি লোক তাহার হাতে একখানি চিঠি দিল। খামের উপরকার অক্ষর দেখায়াই সে আশ্চর্য হইয়া গেল। খুলিয়া দেখিল রমেশ লিখিয়াছে— সে বিশাইপুরে একটি দোকানে অপেক্ষা করিতেছে, বিশেষ কয়েকটি কথা বলিবার আছে।

যোগেন্দ্র একেবারে চৌকি ছাড়িয়া লাফাইয়া উঠিল। রমেশকে যদিও সে একদিন অপমান করিতে বাধ্য হইয়াছিল তবু সেই বাল্যবন্ধুকে এই দূরদেশে এতদিন অদর্শনের পরে ফিরাইয়া দিতে পারিল না। এমন-কি, তাহার মনের মধ্যে একটা আনন্দই হইল, কৌতূহলও কম হইল না। বিশেষত হেমনলিনী যখন কাছে নাই, তখন রমেশের দ্বারা কোনো অনিষ্টের আশঙ্কা করা যায় না।

পত্রবাহকটিকে সঙ্গে করিয়া যোগেন্দ্র নিজেই রমেশের সন্ধানে চলিল। দেখিল, সে একটি মুদির দোকানে একটা শূন্য কেরোসিনের বাক্স খাড়া করিয়া তাহার উপরে চুপ করিয়া বসিয়া আছে; মুদি ব্রাহ্মণের হুঁকায় তাহাকে তামাক দিতে প্রস্তুত হইয়াছিল, কিন্তু চশমা-পরা বাবুটি তামাক খায় না শুনিয়া মুদি তাহাকে শহরজাত কোনো অদ্ভুতশ্রেণীর পদার্থের মধ্যে গণ্য করিয়াছিল। সেই অবধি পরস্পরের মধ্যে কোনোপ্রকার আলাপ-পরিচয়ের চেষ্টা হয় নাই।

যোগেন্দ্র সবেগে আসিয়া একেবারে রমেশের হাত ধরিয়া তাহাকে টানিয়া তুলিল; কহিল, “তোমার সঙ্গে পারা গেল না। তুমি আপনার দ্বিধা লইয়াই গেলে। কোথায় একেবারে সোজা আমার বাসায় আসিয়া হাজির হইবে, না, পথের মধ্যে মুদির দোকানে গুড়ের বাতাসা ও মুড়ির চাকতির মাঝখানে অটল হইয়া বসিয়া আছ!”

রমেশ অপ্রতিভ হইয়া একটুখানি হাসিল। যোগেন্দ্র পথের মধ্যে অনর্গল বকিয়া যাইতে লাগিল; কহিল, “যিনিই যাই বলুন, বিধাতাকে আমরা কেহই চিনিতে পারি নাই। তিনি আমাকে শহরের মধ্যে মানুষ করিয়া এতবড়ো শাহরিক করিয়া তুলিলেন, সে কি এই ঘোর পাড়াগাঁয়ের মধ্যে আমার জীবাত্মাটাকে একেবারে মাঠে মারিবার জন্য?”

রমেশ চারি দিকে তাকাইয়া কহিল, “কেন, জায়গাটি তো মন্দ নয়।”

যোগেন্দ্র। অর্থাৎ?

রমেশ। অর্থাৎ, নির্জন—

যোগেন্দ্র। এইজন্য আমার মতো আরো একটি জনকে বাদ দিয়া এই নির্জনতা আর-একটু বাড়াইবার জন্য আমি অহরহ ব্যাকুল হইয়া আছি।

রমেশ। যাই বল, মনের শান্তির পক্ষে—

যোগেন্দ্র। ও-সব কথা আমাকে বলিয়ো না— কয়দিন প্রচুর মনের শান্তি লইয়া আমার প্রাণ একেবারে কণ্ঠাগত হইয়া