প্রকল্প সম্বন্ধেপ্রকল্প রূপায়ণেরবীন্দ্র-রচনাবলীজ্ঞাতব্য বিষয়পাঠকের চোখেআমাদের লিখুনডাউনলোডঅন্যান্য রচনা-সম্ভার |
নলিনাক্ষ। অন্নদাবাবু, আমিও আপনার দলে; আমরা চেলার দল। যেখানে আমাদের কিছু শিখিবার সম্ভাবনা আছে সেইখানেই আমরা তলপি বহিয়া বেড়াইব।
যোগেন্দ্র অধীর হইয়া কহিল, “না না, কথাটা ভালো নয়। নলিনবাবু, কেহই যে আপনার বন্ধু বা আত্মীয় হইতে পারিবে না, যাহারা আপনার কাছে আসিবে, তাহারাই আপনার চেলা বলিয়া খ্যাত হইয়া যাইবে, এমন বদনামটা হাসিয়া উড়াইয়া দিবার নহে। আপনি কী সব কাণ্ড করেন, ওগুলা ছাড়িয়া দিন।”
নলিনাক্ষ। কী করিয়া থাকি বলুন।
যোগেন্দ্র। ঐ-যে শুনিয়াছি প্রাণায়াম করেন, ভোরের বেলায় সূর্যের দিকে তাকাইয়া থাকেন, খাওয়া দাওয়া লইয়া নানাপ্রকার আচার-বিচার করিতে ছাড়েন না, ইহাতে দশের মধ্যে আপনি খাপছাড়া হইয়া পড়েন।
যোগেন্দ্রের এই রূঢ়বাক্যে ব্যথিত হইয়া হেমনলিনী মাথা নিচু করিল। নলিনাক্ষ হাসিয়া কহিল, “যোগেনবাবু দশের মধ্যে খাপছাড়া হওয়াটা দোষের। কিন্তু তলোয়ারই কী, আর মানুষই কী, তাহার সবটাই কি খাপের মধ্যে থাকে? খাপের ভিতরে তলোয়ারের যে অংশটা থাকিতে বাধ্য সেটাতে সকল তলোয়ারেরই ঐক্য আছে-বাহিরের হাতলটাতে শিল্পীর ইচ্ছা ও নৈপুণ্য-অনুসারে কারিগরি নানা রকমের হইয়া থাকে। মানুষেরও দশের খাপের বাহিরে নিজের বিশেষ কারিগরির একটা জায়গা আছে, সেটাও কি আপনারা বেদখল করিতে চান? আর, আমার কাছে এও আশ্চর্য লাগে, আমি সকলের অগোচরে ঘরে বসিয়া যে-সকল নিরীহ অনুষ্ঠান করিয়া থাকি তাহা লোকের চোখেই বা পড়ে কী করিয়া, আর তাহা লইয়া আলোচনাই বা হয় কেন?”
যোগেন্দ্র। আপনি তা জানেন না বুঝি? যাহারা জগতের উন্নতির ভার সম্পূর্ণ নিজের স্কন্ধে লইয়াছে তাহারা পরের ঘরে কোথায় কী ঘটিতেছে তাহা খুঁজিয়া বাহির করা কর্তব্যের মধ্যেই গণ্য করে। যেটুকু খবর না পায় সেটুকু পূরণ করিয়া লইবার শক্তিও তাহাদের আছে। এ নহিলে বিশ্বের সংশোধনকার্য চলিবে কী করিয়া? তা ছাড়া নলিনবাবু, পাঁচ জনে যাহা না করে তাহা চোখের আড়ালে করিলেও চোখে পড়িয়া যায়, যাহা সকলেই করে তাহাতে কেহ দৃষ্টিপাত করে না। এই দেখুন-না কেন, আপনি ছাদে বসিয়া কী সব কাণ্ড করেন তাহা আমাদের হেমের চোখেও পড়িয়া গেছে— হেম সে কথা বাবাকে বলিতেছিল— অথচ হেম তো আপনার সংশোধনের ভার গ্রহণ করে নাই।
হেমনলিনীর মুখ আরক্ত হইয়া উঠিল; সে ব্যথিত হইয়া একটা-কী বলিবার উপক্রম করিবামাত্র নলিনাক্ষ কহিল, “আপনি কিছুমাত্র লজ্জা পাইবেন না; ছাদে বেড়াইতে উঠিয়া সকালে-সন্ধ্যায় আপনি যদি আমার আহ্নিককৃত্য দেখিয়া থাকেন, সেজন্য আপনাকে কে দোষী করিবে? আপনার দুটি চক্ষু আছে বলিয়া আপনি লজ্জিত হইবেন না; ও দোষটা আমাদেরও আছে।”
অন্নদা। তা ছাড়া হেম আপনার আহ্নিক সম্বন্ধে আমার কাছে কোনো আপত্তি প্রকাশ করে নাই। সে শ্রদ্ধাপূর্বক আপনার সাধনপ্রণালী সম্বন্ধে আমাকে প্রশ্ন করিতেছিল।
যোগেন্দ্র। আমি কিন্তু ও-সব কিছু বুঝি না। আমরা সাধারণে সংসারে সহজ রকমে যে ভাবে চলিয়া যাইতেছি তাহাতে কোনো বিশেষ অসুবিধা দেখিতেছি না— গোপনে অদ্ভুত কাণ্ড করিয়া বিশেষ কিছু যে লাভ হয় আমার তাহা মনে হয় না— বরং উহাতে মনের যেন একটা সামঞ্জস্য নষ্ট হইয়া মানুষকে একঝোঁকা করিয়া দেয়। কিন্তু আপনি আমার কথায় রাগ করিবেন না— আমি নিতান্তই সাধারণ মানুষ, পৃথিবীর মধ্যে আমি নেহাত মাঝারি রকম জায়গাটাতেই থাকি; যাঁহারা কোনোপ্রকার উচ্চমঞ্চে চড়িয়া বসেন আমার পক্ষে ঢেলা না মারিয়া তাঁহাদের নাগাল পাইবার কোনো সম্ভাবনা নাই। আমার মতো এমন অসংখ্য লোক আছে, অতএব আপনি যদি সকলকে ছাড়িয়া কোনো অদ্ভুতলোকে উধাও হইয়া যান তবে আপনাকে অসংখ্য ঢেলা খাইতে হইবে।