নৌকাডুবি

রমেশ। বাবু কোথায় গেছেন?

বেহারা। দিদিঠাকরুনকে লইয়া পশ্চিমে হাওয়া খাইতে গিয়াছেন।

রমেশ। কোথায় গেছেন?

বেহারা। তাহা তো বলিতে পারি না।

রমেশ। আর কে সঙ্গে গেছেন?

বেহারা। নলিনবাবু সঙ্গে গেছেন।

রমেশ। নলিনবাবুটি কে?

বেহারা। তাহা তো বলিতে পারি না।

রমেশ প্রশ্ন করিয়া করিয়া জানিল নলিনবাবু যুবাপুরুষ, কিছুকাল হইতে এই বাড়িতে যাতায়াত করিতেছেন। যদিও রমেশ হেমনলিনীর আশা ত্যাগ করিয়াই যাইতেছিল, তথাপি নলিনবাবুটির প্রতি তাহার সদ্ভাব আকৃষ্ট হইল না।

রমেশ। তোর দিদিঠাকরুনের শরীর কেমন আছে?

বেহারা কহিল, “তাঁহার শরীর তো ভালোই আছে।”

সুখন-বেহারাটা ভাবিয়াছিল, এই সুসংবাদে রমেশবাবু নিশ্চিন্ত ও সুখী হইবেন। অন্তর্যামী জানেন, সুখন-বেহারা ভুল বুঝিয়াছিল।

রমেশ কহিল, “আমি একবার উপরের ঘরে যাইব।”

বেহারা তাহার ধূমোচ্ছ্বসিত কেরোসিনের ডিপা লইয়া রমেশকে উপরে লইয়া গেল। রমেশ ভূতের মতো ঘরে ঘরে একবার ঘুরিয়া বেড়াইল, দুই-একটা চৌকি ও সোফা বাছিয়া লইয়া তাহার উপরে বসিল। জিনিসপত্র গৃহসজ্জা সমস্তই ঠিক পূর্বের মতোই আছে, মাঝে হইতে নলিনবাবুটি কে আসিল? পৃথিবীতে কাহারো অভাবে অধিক দিন কিছুই শূন্য থাকে না। যে বাতায়নে রমেশ এক দিন হেমনলিনীর পাশে দাঁড়াইয়া ক্ষান্তবর্ষণ শ্রাবণদিনের সূর্যাস্ত-আভায় দুটি হৃদয়ের নিঃশব্দ মিলনকে মণ্ডিত করিয়া লইয়াছিল, সেই বাতায়নে আর কি সূর্যাস্তের আভা পড়ে না? সেই বাতায়নে আর-কেহ আসিয়া আর-এক দিন যখন যুগলমূর্তি রচনা করিতে চাহিবে তখন পূর্ব-ইতিহাস আসিয়া কি তাহাদের স্থান রোধ করিয়া দাঁড়াইবে, নিঃশব্দে তর্জনী তুলিয়া তাহাদিগকে দূরে সরাইয়া দিবে? ক্ষুণ্ন অভিমানে রমেশের হৃদয় স্ফীত হইয়া উঠিতে লাগিল।
পরদিন রমেশ এলাহাবাদে না গিয়া একেবারে গাজিপুরে চলিয়া গেল।


৩৪

কলিকাতায় রমেশ মাসখানেক কাটাইয়া আসিয়াছে। এই এক মাস কমলার পক্ষে অল্পদিন নহে। কমলার জীবনে একটা পরিণতির স্রোত হঠাৎ অত্যন্ত দ্রুতবেগে বহিতেছে। উষার আলো যেমন দেখিতে দেখিতে প্রভাতের রৌদ্রে ফুটিয়া পড়ে, কমলার নারীপ্রকৃতি তেমনি অতি অল্পকালের মধ্যেই সুপ্তি হইতে জাগরণের মধ্যে সচেতন হইয়া উঠিল। শৈলজার সহিত যদি তাহার ঘনিষ্ঠ পরিচয় না হইত, শৈলজার জীবন হইতে প্রেমালোকের ছটা ও উত্তাপ যদি প্রতিফলিত হইয়া তাহার হৃদয়ের উপরে না পড়িত, তবে কতকাল তাহাকে অপেক্ষা করিতে হইতে বলা যায় না।

ইতিমধ্যে রমেশের আসিবার দেরি দেখিয়া শৈলজার বিশেষ অনুরোধে খুড়া কমলাদের বাসের জন্য শহরের বাহিরে গঙ্গার ধারে