প্রকল্প সম্বন্ধেপ্রকল্প রূপায়ণেরবীন্দ্র-রচনাবলীজ্ঞাতব্য বিষয়পাঠকের চোখেআমাদের লিখুনডাউনলোডঅন্যান্য রচনা-সম্ভার |
বিপিন না বসিয়াই একটুখানি মাথা চুলকাইয়া বলিল, “আপনাকে এক বার ইনি ভিতরে ডাকিতেছেন।”
রমেশ জিজ্ঞাসা করিল, “কে, কমলা?”
বিপিন কহিল, “হাঁ।”
রমেশ কিছু আশ্চর্য হইল। রমেশ পূর্বেই স্থির করিয়াছে কমলাকে সে স্ত্রী বলিয়াই গ্রহণ করিবে, কিন্তু তাহার স্বাভাবিক-দ্বিধাগ্রস্ত মন তৎপূর্বে এই কয়দিন অবকাশ পাইয়া বিশ্রাম করিতেছে। কল্পনায় কমলাকে গৃহিণীপদে অভিষিক্ত করিয়া সে মনকে নানাপ্রকার ভাবী সুখের আশ্বাসে উত্তেজিত করিয়াও তুলিয়াছে, কিন্তু প্রথম আরম্ভটাই দুরূহ। কিছুদিন হইতে কমলার প্রতি যেটুকু দূরত্ব রক্ষা করা তাহার অভ্যস্ত হইয়া গেছে হঠাৎ এক দিন কেমন করিয়া সেটা ভাঙিয়া ফেলিবে, তাহা সে ভাবিয়া পাইতেছিল না; এইজন্যই বাড়িভাড়া করিবার দিকে তাহার তেমন সত্বরতা ছিল না।
কমলা ডাকিয়াছে শুনিয়া রমেশের মনে হইল, নিশ্চয় বিশেষ কোনো একটা প্রয়োজন পড়িয়াছে। তবু প্রয়োজনের ডাক হইলেও তাহার মনের মধ্যে একটা হিল্লোল উঠিল। বিপিনের অনুবর্তী হইয়া ‘পায়োনিয়র’টা ফেলিয়া রাখিয়া যখন সে অন্তঃপুরে যাত্রা করিল তখন এই মধুকরগুঞ্জরিত কার্তিকের আলস্যদীর্ঘ জনহীন মধ্যাহ্নে একটা অভিসারের আভাস তাহার চিত্তকে একটুখানি চঞ্চল করিল।
বিপিন কিছুদূর হইতে ঘর দেখাইয়া দিয়া চলিয়া গেল। কমলা মনে করিয়াছিল, শৈলজা তাহার সম্বন্ধে হাল ছাড়িয়া দিয়া বিপিনের কাছে চলিয়া গেছে। তাই সে খোলা দরজার চৌকাঠের উপর বসিয়া সামনের বাগানের দিকে চাহিয়া ছিল। শৈল কেমন করিয়া কমলার অন্তরে-বাহিরে একটা ভালোবাসার সুর বাঁধিয়া দিয়াছিল। ঈষত্তপ্ত বাতাসে বাহিরে গাছের পল্লবগুলি যেমন মর্মরশব্দে কাঁপিয়া উঠিতেছিল, কমলার বুকের ভিতরেও মাঝে মাঝে তেমনি একটা দীর্ঘনিশ্বাসের হাওয়া উঠিয়া অব্যক্ত বেদনায় একটি অপরূপ স্পন্দনের সঞ্চার করিতেছিল।
এমন সময়ে রমেশ ঘরে প্রবেশ করিয়া যখন তাহার পশ্চাৎ হইতে ডাকিল— ‘কমলা’, তখন সে চকিত হইয়া উঠিয়া পড়িল; তাহার হৃৎপিণ্ডের মধ্যে রক্ত তরঙ্গিত হইতে লাগিল, যে কমলা ইতিপূর্বে কখনো রমেশের কাছে বিশেষ লজ্জা অনুভব করে নাই সে আজ ভালো করিয়া মুখ তুলিয়া চাহিতে পারিল না। তাহার কর্ণমূল আরক্তিম হইয়া উঠিল।
আজিকার সাজসজ্জায় ও ভাবে-আভাসে রমেশ কমলাকে নূতন মূর্তিতে দেখিল। হঠাৎ কমলার এই বিকাশ তাহাকে আশ্চর্য এবং অভিভূত করিল। সে আস্তে আস্তে কমলার কাছে আসিয়া ক্ষণকালের জন্য চুপ করিয়া দাঁড়াইয়া মৃদুস্বরে কহিল, “কমলা, তুমি আমাকে ডাকিয়াছ?”
কমলা চমকিয়া উঠিয়া অনাবশ্যক উত্তেজনার সহিত বলিয়া উঠিল, “না না না, আমি ডাকি নাই— আমি কেন ডাকিতে যাইব?”
রমেশ কহিল, “ডাকিলেই বা দোষ কী কমলা?”
কমলা দ্বিগুণ প্রবলতার সহিত বলিল, “না, আমি ডাকি নাই।”
রমেশ কহিল, “তা, বেশ কথা। তুমি না ডাকিতেই আমি আসিয়াছি। তাই বলিয়াই কি অনাদরে ফিরিয়া যাইতে হইবে?”
কমলা। তুমি এখানে আসিয়াছ, সকলে জানিতে পারিলে রাগ করিবেন— তুমি যাও। আমি তোমাকে ডাকি নাই।
রমেশ কমলার হাত চাপিয়া ধরিয়া কহিল, “আচ্ছা, তুমি আমার ঘরে এসো— সেখানে বাহিরের লোক কেহ নাই।”
কমলা কম্পিতকলেবরে তাড়াতাড়ি রমেশের হাত ছাড়াইয়া লইয়া পাশের ঘরে গিয়া দ্বার রুদ্ধ করিল।
রমেশ বুঝিল, এ-সমস্তই বাড়ির কোনো মেয়ের ষড়্যন্ত্র— এই বুঝিয়া পুলকিতদেহে বাহিরের ঘরে গেল। চিত হইয়া পড়িয়া