নৌকাডুবি

শহর এবং সাহেবপাড়ার মাঝামাঝি একটা জায়গায় খুড়োমশায়ের একটি ছোটো বাংলা। তাহার পশ্চাতে আমবাগান, সম্মুখে বাঁধানো কূপ, সামনের দিকে অনুচ্চ প্রাচীরের বেষ্টন— কূপের সিঞ্চিত জলে কপি-কড়াইশুঁটির খেত শ্রীবৃদ্ধিলাভ করিয়াছে।

প্রথম দিনে কমলা ও রমেশ এই বাংলাতে গিয়াই উঠিল।

চক্রবর্তী-খুড়ার স্ত্রী হরিভাবিনীর শরীর কাহিল বলিয়া খুড়া লোকসমাজে প্রচার করেন, কিন্তু তাঁহার দৌর্বল্যের বাহ্যলক্ষণ কিছুই দেখিতে পাওয়া যায় না। তাঁহার বয়স নিতান্ত অল্প নহে, কিন্তু শক্তসমর্থ চেহারা। সামনের কিছু কিছু চুল পাকিয়াছে, কিন্তু কাঁচার অংশই বেশি। তাঁহার সম্বন্ধে জরা যেন কেবলমাত্র ডিক্রি পাইয়াছে, কিন্তু দখল পাইতেছে না।

আসল কথা, এই দম্পতিটি যখন তরুণ ছিলেন তখন হরিভাবিনীকে ম্যালেরিয়ায় খুব শক্ত করিয়া ধরে। বায়ুপরিবর্তন ছাড়া আর-কোনো উপায় না দেখিয়া চক্রবর্তী গাজিপুর ইস্কুলের মাস্টারি জোগাড় করিয়া এখানে আসিয়া বাস করেন। স্ত্রী সম্পূর্ণ সুস্থ হইলেও তাঁহার স্বাস্থ্যের প্রতি চক্রবর্তীর কিছুমাত্র আস্থা জন্মে নাই।

অতিথিদিগকে বাহিরের ঘরে বসাইয়া চক্রবর্তী অন্তঃপুরে প্রবেশ করিয়া ডাকিলেন, “সেজবউ!”

সেজবউ তখন প্রাচীরবেষ্টিত প্রাঙ্গণে রামকৌলিকে দিয়া গম ভাঙাইতেছিলেন এবং ছোটোবড়ো নানাপ্রকার ভাঁড়ে ও হাঁড়িতে নানাজাতীয় চাটনি রৌদ্রে সাজাইতেছিলেন।

চক্রবর্তী আসিয়াই কহিলেন, “এই বুঝি! ঠাণ্ডা পড়িয়াছে— গায়ে একখানা র‍্যাপার দিতে নাই?”

হরিভাবিনী। তোমার সকল অনাসৃষ্টি। ঠাণ্ডা আবার কোথায়— রৌদ্রে পিঠ পুড়িতেছে।

চক্রবর্তী। সেটাই কি ভালো? ছায়া জিনিসটা তো দুর্মূল্য নয়।

হরিভাবিনী। আচ্ছা, সে হবে, তুমি আসিতে এত দেরি করিলে কেন?

চক্রবর্তী। সে অনেক কথা। আপাতত ঘরে অতিথি উপস্থিত, সেবার আয়োজন করিতে হইবে।

এই বলিয়া চক্রবর্তী অভ্যাগতদের পরিচয় দিলেন। চক্রবর্তীর ঘরে হঠাৎ এরূপ বিদেশী অতিথির সমাগম প্রায়ই ঘটিয়া থাকে, কিন্তু সস্ত্রীক অতিথির জন্য হরিভাবিনী প্রস্তুত ছিলেন না; তিনি কহিলেন, “ওমা, তোমার এখানে ঘর কোথায়?”

চক্রবর্তী কহিলেন, “আগে তো পরিচয় হউক, তার পরে ঘরের কথা পরে হইবে। আমাদের শৈল কোথায়?”

হরিভাবিনী। সে তাহার ছেলেকে স্নান করাইতেছে।

চক্রবর্তী তাড়াতাড়ি কমলাকে অন্তঃপুরে ডাকিয়া আনিলেন। কমলা হরিভাবিনীকে প্রণাম করিয়া দাঁড়াইতেই তিনি দক্ষিণ করপুটে কমলার চিবুক স্পর্শ করিয়া নিজের অঙ্গুলি চুম্বন করিলেন এবং স্বামীকে কহিলেন, “দেখিয়াছ, মুখখানি অনেকটা আমাদের বিধুর মতো।”

বিধু ইঁহাদের বড়ো মেয়ে, কানপুরে স্বামিগৃহে থাকে। চক্রবর্তী মনে মনে হাসিলেন। তিনি জানিতেন কমলার সহিত বিধুর কোনো সাদৃশ্য নাই, কিন্তু হরিভাবিনী রূপগুণে বাহিরের মেয়ের জয় স্বীকার করিতে পারেন না। শৈলজা তাঁহার ঘরেই থাকে, পাছে তাহার সহিত প্রত্যক্ষ তুলনায় বিচারে হার হয়, এইজন্য অনুপস্থিতকে উপমাস্থলে রাখিয়া জয়পতাকা গৃহিণী আপন গৃহের মধ্যেই অচল করিলেন।

হরিভাবিনী। ইঁহারা আসিয়াছেন, তা বেশ হইয়াছে, কিন্তু আমাদের নতুন বাড়ির তো মেরামত শেষ হয় নাই— এখানে আমরা কোনোমতে মাথা গুঁজিয়া আছি— ইঁহাদের যে কষ্ট হইবে।

বাজারে চক্রবর্তীর একটা ছোটো বাড়ি মেরামত হইতেছে বটে, কিন্তু সেটা একটা দোকান; সেখানে বাস করিবার কোনো সুবিধাও নাই, সংকল্পও নাই।