প্রকল্প সম্বন্ধেপ্রকল্প রূপায়ণেরবীন্দ্র-রচনাবলীজ্ঞাতব্য বিষয়পাঠকের চোখেআমাদের লিখুনডাউনলোডঅন্যান্য রচনা-সম্ভার |
কমলা হাসিমুখে কহিল, “আমি আপনার কাছ থেকে অম্বল-রাঁধা শিখিব।”
চক্রবর্তী। ওরে বাস্ রে! বিদ্যা কি এত সহজে দেওয়া যায়? এক দিনেই শিখাইয়া বিদ্যার গুমর যদি নষ্ট করি তবে বীণাপাণি অপ্রসন্ন হইবেন। দু-চার দিন এ বৃদ্ধকে খোশামোদ করিতে হইবে। আমাকে কী করিয়া খুশি করিতে হয় সে তোমাকে ভাবিয়া বাহির করিতে হইবে না; আমি নিজে সমস্ত বিস্তারিত বলিয়া দিব। প্রথম দফায়, আমি পানটা কিছু বেশি খাই, কিন্তু সুপারি গোটা-গোটা থাকিলে চলিবে না। আমাকে বশীভূত করা সহজ ব্যাপার না; কিন্তু মা'র ঐ হাসি-মুখখানিতে কাজ অনেকটা অগ্রসর হইয়াছে। ওরে, তোর নাম কী রে?”
উমেশ উত্তর দিল না। সে রাগিয়া ছিল; তাহার মনে হইতেছিল, কমলার স্নেহ-রাজ্যে বৃদ্ধ তাহার শরিক হইয়া আসিয়া উপস্থিত হইয়াছে। কমলা তাহাকে মৌন দেখিয়া কহিল, “ওর নাম উমেশ।”
বৃদ্ধ কহিলেন, “এ ছোকরাটি বেশ ভালো। এক দমে ইহার মন পাওয়া যায় না তাহা স্পষ্ট দেখিতেছি, কিন্তু দেখো মা, এর সঙ্গে আমার বনিবে। কিন্তু আর বেলা করিয়ো না, আমার রান্না হইতে কিছুমাত্র বিলম্ব হইবে না।”
কমলা যে একটা শূন্যতা অনুভব করিতেছিল এই বৃদ্ধকে পাইয়া তাহা ভুলিয়া গেল।
রমেশও এই বৃদ্ধের আগমনে এখনকার মতো কতকটা নিশ্চিন্ত হইল। প্রথম কয় মাস যখন রমেশ কমলাকে আপনার স্ত্রী বলিয়াই জানিত তখন তাহার আচরণ, তখন পরস্পরের বাধাবিহীন নিকটবর্তিতা, এখনকার হইতে এতই তফাৎ যে, এই হঠাৎ-প্রভেদ বালিকার মনকে আঘাত না করিয়া থাকিতে পারে না। এমন সময়ে এই চক্রবর্তী আসিয়া রমেশের দিক হইতে কমলার চিন্তাকে যদি খানিকটা বিক্ষিপ্ত করিতে পারে তবে রমেশ আপনার হৃদয়ের ক্ষতবেদনায় অখণ্ড মনোযোগ দিয়া বাঁচে।
অদূরে তাহার কামরার দ্বারের কাছে আসিয়া কমলা দাঁড়াইল। তাহার মনের ইচ্ছা, কর্মহীন দীর্ঘমধ্যাহ্নটা সে চক্রবর্তীকে একাকী দখল করিয়া বসে। চক্রবর্তী তাহাকে দেখিয়া বলিয়া উঠিলেন, “না না মা, এটা ভালো হইল না। এটা কিছুতেই চলিবে না।”
কমলা, কী ভালো হইল না কিছু বুঝিতে না পারিয়া আশ্চর্য ও কুণ্ঠিত হইয়া উঠিল। বৃদ্ধ কহিলেন, “ঐ যে, ঐ জুতোটা। রমেশবাবু, এটা আপনা কর্তৃকই হইয়াছে। যা বলেন, এটা আপনারা অধর্ম করিতেছেন-দেশের মাটিকে এই-সকল চরণস্পর্শ হইতে বঞ্চিত করিবেন না, তাহা হইলে দেশ মাটি হইবে। রামচন্দ্র যদি সীতাকে ডসনের বুট পরাইতেন তবে লক্ষ্মণ কি চোদ্দ বৎসর বনে ফিরিয়া বেড়াইত পারিতেন মনে করেন? কখনোই না। আমার কথা শুনিয়া রমেশবাবু হাসিতেছেন, মনে মনে ঠিক পছন্দ করিতেছেন না। না করিবারই কথা। আপনারা জাহাজের বাঁশি শুনিলেই আর থাকিতে পারেন না, একেবারেই চড়িয়া বসেন, কিন্তু কোথায় যে যাইতেছেন তাহা একবারও ভাবেন না।”
রমেশ কহিল, “খুড়ো, আপনিই নাহয় আমাদের গম্যস্থানটা ঠিক করিয়া দিন-না। জাহাজের বাঁশিটার চেয়ে আপনার পরামর্শ পাকা হইবে।”
চক্রবর্তী কহিলেন, “এই দেখুন, আপনার বিবেচনাশক্তি এরই মধ্যে উন্নতি লাভ করিয়াছে— অথচ অল্পক্ষণের পরিচয়। তবে