নৌকাডুবি
বাহিরে ছুটিয়া আসিতে চাহিল। একটুখানি মাত্র ঘর— কিন্তু সে ঘর কোথায়! শূন্য তীর ধুধু করিতেছে, প্রকাণ্ড আকাশ দিগন্ত হইতে দিগন্ত পর্যন্ত স্তব্ধ। অনাবশ্যক আকাশ, অনাবশ্যক পৃথিবী— ক্ষুদ্র বালিকার পক্ষে এই অন্তহীন বিশালতা অপরিসীম অনাবশ্যক— কেবল তাহার একটিমাত্র ঘরের প্রয়োজন ছিল।

এমন সময় হঠাৎ কমলা চমকিয়া উঠিল— কে একজন তাহার অনতিদূরে দাঁড়াইয়া আছে।

“ভয় নাই মা, আমি উমেশ। রাত যে অনেক হইয়াছে, ঘুম নাই কেন?”

এতক্ষণ যে অশ্রু পড়ে নাই, দেখিতে দেখিতে দুই চক্ষু দিয়া সেই অশ্রু উছলিয়া পড়িল। বড়ো বড়ো ফোঁটা কিছুতে বাধা মানিল না, কেবলই ঝরিয়া পড়িতে লাগিল। ঘাড় বাঁকাইয়া কমলা উমেশের দিক হইতে মুখ ফিরাইয়া লইল। জলভার বহিয়া মেঘ ভাসিয়া যাইতেছে— যেমনি তাহারই মতো আর-একটা গৃহহারা হাওয়ার স্পর্শ লাগে অমনি সমস্ত জলের বোঝা ঝরিয়া পড়ে; এই গৃহহীন দরিদ্র বালকটার কাছ হইতে একটা যত্নের কথা শুনিবামাত্র কমলা আপনার বুক-ভরা অশ্রুর ভার আর রাখিতে পারিল না। একটা-কোনো কথা বলিবার চেষ্টা করিল, কিন্তু রুদ্ধ কণ্ঠ দিয়া কথা বাহির হইল না।

পীড়িতচিত্ত উমেশ কেমন করিয়া সান্ত্বনা দিতে হয় ভাবিয়া পাইল না। অবশেষে অনেকক্ষণ চুপ করিয়া থাকিয়া হঠাৎ এক সময়ে বলিয়া উঠিল, “মা, তুমি যে সেই টাকাটা দিয়াছিলে, তার থেকে সাত আনা বাঁচিয়াছে।”

তখন কমলার অশ্রুর ভার লঘু হইয়াছে। উমেশের এই খাপছাড়া সংবাদে সে একটুখানি স্নেহমিশ্রিত হাসি হাসিয়া কহিল, “আচ্ছা, বেশ, সে তোর কাছে রাখিয়া দে। যা, এখন শুতে যা।”

চাঁদ গাছের আড়ালে নামিয়া পড়িল। এবার কমলা বিছানায় আসিয়া যেমন শুইল অমনি তাহার দুই শ্রান্ত চক্ষু ঘুমে বুজিয়া আসিল। প্রভাতের রৌদ্র যখন তাহার ঘরের দ্বারে করাঘাত করিল তখনো সে নিদ্রায় মগ্ন।


২৮

শ্রান্তির মধ্যে পরের দিন কমলার দিবসারম্ভ হইল। সেদিন তাহার চক্ষে সূর্যের আলোক ক্লান্ত, নদীর ধারা ক্লান্ত, তীরের তরুগুলি বহুদূরপথের পথিকের মতো ক্লান্ত।

উমেশ যখন তাহার কাজে সহায়তা করিতে আসিল কমলা শ্রান্তকণ্ঠে কহিল, “যা উমেশ, আমাকে আজ আর বিরক্ত করিস নে।”

উমেশ অল্পে ক্ষান্ত হইবার ছেলে নহে। সে কহিল, “বিরক্ত করিব কেন মা, বাটনা বাটিতে আসিয়াছি।”

সকালবেলা রমেশ কমলার চোখমুখের ভাব দেখিয়া জিজ্ঞাসা করিয়াছিল, “কমলা, তোমার কি অসুখ করিয়াছে?”

এরূপ প্রশ্ন যে কতখানি অনাবশ্যক ও অসংগত, কমলা কেবল তাহা একবার প্রবল গ্রীবা-আন্দোলনের দ্বারা নিরুত্তরে প্রকাশ করিয়া রান্নাঘরের দিকে চলিয়া গেল।

রমেশ বুঝিল, সমস্যা ক্রমশ প্রতিদিনই কঠিন হইয়া আসিতেছে। অতিশীঘ্রই ইহার একটা শেষ মীমাংসা হওয়া আবশ্যক। হেমনলিনীর সঙ্গে একবার স্পষ্ট বোঝাপড়া হইয়া গেলে কর্তব্যনির্ধারণ সহজ হইবে, ইহা রমেশ মনে মনে আলোচনা করিয়া দেখিল।

অনেক চিন্তার পর হেমকে চিঠি লিখিতে বসিল। একবার লিখিতেছে, একবার কাটিতেছে, এমন সময় “মহাশয়, আপনার