নৌকাডুবি
নতমুখে তাঁহার চা প্রস্তুত করিয়া দিতে লাগিল।

যোগেন্দ্র হেমনলিনীর ব্যবহারে অত্যন্ত বিরক্ত হইয়াছিল। হেম যে রমেশের জন্য এমন করিয়া শোক অনুভব করিবে, ইহা তাহার অসহ্য বোধ হইতেছিল। তাহার পরে যখন দেখিল, অন্নদাবাবু তাহার এই শোকের সঙ্গী হইয়াছেন এবং সেও যেন সংসারের আর-সকলের নিকট হইতে অন্নদাবাবুর স্নেহচ্ছায়ায় আপনাকে রক্ষা করিতে চেষ্টা করিতেছে, তখন তাহার অধৈর্য আরো বাড়িয়া উঠিল।— ’আমরা যেন সবাই অন্যায়কারী! আমরা যে স্নেহের খাতিরেই কর্তব্যপালনে চেষ্টা করিতেছি, আমরাই যে যথার্থভাবে উহার মঙ্গলসাধনে প্রবৃত্ত, তাহার জন্য লেশমাত্র কৃতজ্ঞতা দূরে থাক্‌, মনে মনে আমাদের দোষী করিতেছে। বাবার তো কোনো বিষয়ে কাণ্ডজ্ঞান নাই। এখন সান্ত্বনা দিবার সময় নহে, এখন আঘাত দিবারই সময়। তাহা না করিয়া তিনি ক্রমাগতই অপ্রিয় সত্যকে উহার নিকট হইতে দূরে খেদাইয়া রাখিতেছেন।’

যোগেন্দ্র অন্নদাবাবুকে সম্বোধন করিয়া কহিল, “জান বাবা, কী হইয়াছে?”

অন্নদাবাবু ত্রস্ত হইয়া উঠিয়া কহিলেন, “না, কী হইয়াছে?”

যোগেন্দ্র। রমেশ কাল তাহার স্ত্রীকে লইয়া গোয়ালন্দ মেলে দেশে যাইতেছিল, অক্ষয়কে সেই গাড়িতে উঠিতে দেখিয়া দেশে না গিয়া আবার সে কলিকাতায় পালাইয়া আসিয়াছে।

হেমনলিনীর হাত কাঁপিয়া উঠিল, চা ঢালিতে চা পড়িয়া গেল। সে চৌকিতে বসিয়া পড়িল।

যোগেন্দ্র তাহার মুখের দিকে একবার কটাক্ষপাত করিয়া বলিতে লাগিল, “পালাইবার কী দরকার ছিল, আমি তো কিছুই বুঝিতে পারি না। অক্ষয়ের কাছে তো পূর্বেই সমস্ত প্রকাশ হইয়া গিয়াছিল। একে তো তাহার পূর্বের ব্যবহার যথেষ্ট হেয়, তাহার পরে এই ভীরুতা, এই চোরের মতো ক্রমাগত পালাইয়া বেড়ানো আমার কাছে অত্যন্ত জঘন্য মনে হয়। জানি না হেম কী মনে করে, কিন্তু এইরূপ পলায়নেই তাহার অপরাধের যথেষ্ট প্রমাণ হইতেছে।”

হেমনলিনী কাঁপিতে কাঁপিতে চৌকি ছাড়িয়া উঠিয়া দাঁড়াইল; কহিল, “দাদা, আমি প্রমাণের কোনো অপেক্ষা রাখি না। তোমরা তাঁহার বিচার করিতে চাও করো, আমি তাঁহার বিচারক নই।”

যোগেন্দ্র। তোমার সঙ্গে যাহার বিবাহের সম্বন্ধ হইতেছে সে কি আমাদের নিঃসম্পর্ক?

হেমনলিনী। বিবাহের কথা কে বলিতেছে? তোমরা ভাঙিয়া দিতে চাও ভাঙিয়া দাও— সে তোমাদের ইচ্ছা। কিন্তু আমার মন ভাঙাইবার জন্য মিথ্যা চেষ্টা করিতেছ।

বলিতে বলিতে হেমনলিনী স্বরবদ্ধ হইয়া কাঁদিয়া উঠিল। অন্নদাবাবু তাড়াতাড়ি উঠিয়া তাহার অশ্রুসিক্তমুখ বুকে চাপিয়া ধরিয়া কহিলেন, “চলো হেম, আমরা উপরে যাই।”


২৩

স্টীমার ছাড়িয়া দিল। প্রথম দ্বিতীয় শ্রেণীর কামরায় কেহই ছিল না। রমেশ একটি কামরা বাছিয়া লইয়া বিছানা পাতিয়া দিল। সকালবেলা দুধ খাইয়া সেই কামরার দরজা খুলিয়া কমলা নদী ও নদীতীর দেখিতে লাগিল।

রমেশ কহিল, “জান, কমলা, আমরা কোথায় যাইতেছি?”

কমলা কহিল, “দেশে যাইতেছি।”

রমেশ। দেশ তো তোমার ভালো লাগে না— আমরা দেশে যাইব না।