প্রকল্প সম্বন্ধেপ্রকল্প রূপায়ণেরবীন্দ্র-রচনাবলীজ্ঞাতব্য বিষয়পাঠকের চোখেআমাদের লিখুনডাউনলোডঅন্যান্য রচনা-সম্ভার |
গোরা চকিত হইয়া উঠিয়া কহিল, “আমি ওঁর পুত্র নই?”
আনন্দময়ী কহিলেন, “না।”
অগ্নিগিরির অগ্নি-উচ্ছ্বাসের মতো তখন গোরার মুখ দিয়া বাহির হইল, “মা, তুমি আমার মা নও?”
আনন্দময়ীর বুক ফাটিয়া গেল; তিনি অশ্রুহীন রোদনের কণ্ঠে কহিলেন, “বাবা, গোরা, তুই যে আমার পুত্রহীনার পুত্র, তুই যে গর্ভের ছেলের চেয়ে অনেক বেশি বাবা!”
গোরা তখন কৃষ্ণদয়ালের মুখের দিকে চাহিয়া কহিল, “আমাকে তবে তোমরা কোথায় পেলে?”
কৃষ্ণদয়াল কহিলেন, “তখন মিউটিনি। আমরা এটোয়াতে। তোমার মা সিপাহিদের ভয়ে পালিয়ে এসে রাত্রে আমাদের বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছিলেন। তোমার বাপ তার আগের দিনেই লড়াইয়ে মারা গিয়েছিলেন। তাঁর নাম ছিল— ”
গোরা গর্জন করিয়া বলিয়া উঠিল, “দরকার নেই তাঁর নাম। আমি নাম জানতে চাই নে।”
কৃষ্ণদয়াল গোরার এই উত্তেজনায় বিস্মিত হইয়া থামিয়া গেলেন। তার পর বলিলেন, “তিনি আইরিশম্যান ছিলেন। সেই রাত্রেই তোমার মা তোমাকে প্রসব করে মারা গেলেন। তার পর থেকেই তুমি আমাদের ঘরে মানুষ হয়েছ।”
এক মুহূর্তেই গোরার কাছে তাহার সমস্ত জীবন অত্যন্ত অদ্ভুত একটা স্বপ্নের মতো হইয়া গেল। শৈশব হইতে এত বৎসর তাহার জীবনের যে ভিত্তি গড়িয়া উঠিয়াছিল তাহা একেবারেই বিলীন হইয়া গেল। সে যে কী, সে যে কোথায় আছে, তাহা যেন বুঝিতেই পারিল না। তাহার পশ্চাতে অতীতকাল বলিয়া যেন কোনো পদার্থই নাই এবং তাহার সম্মুখে তাহার এতকালের এমন একাগ্রলক্ষবর্তী সুনির্দিষ্ট ভবিষ্যৎ একেবারে বিলুপ্ত হইয়া গেছে। সে যেন কেবল এক মুহূর্ত-মাত্রের পদ্মপত্রে শিশিরবিন্দুর মতো ভাসিতেছে। তাহার মা নাই, বাপ নাই, দেশ নাই, জাতি নাই, নাম নাই, গোত্র নাই, দেবতা নাই। তাহার সমস্তই একটা কেবল ‘না’। সে কী ধরিবে, কী করিবে, আবার কোথা হইতে শুরু করিবে, আবার কোন্ দিকে লক্ষ্য স্থির করিবে, আবার দিনে দিনে ক্রমে ক্রমে কর্মের উপকরণ-সকল কোথা হইতে কেমন করিয়া সংগ্রহ করিয়া তুলিবে! এই দিক্চিহ্নহীন অদ্ভুত শূন্যের মধ্যে গোরা নির্বাক্ হইয়া বসিয়া রহিল। তাহার মুখ দেখিয়া কেহ তাহাকে আর দ্বিতীয় কথাটি বলিতে সাহস করিল না।
এমন সময় পরিবারের বাঙালি চিকিৎসকের সঙ্গে সাহেব-ডাক্তার আসিয়া উপস্থিত হইল। ডাক্তার যেমন রোগীর দিকে তাকাইল তেমনি গোরার দিকেও না তাকাইয়া থাকিতে পারিল না। ভাবিল, এ মানুষটা কে! তখনো গোরার কপালে গঙ্গা-মৃত্তিকার তিলক ছিল এবং স্নানের পরে সে যে গরদ পরিয়াছিল তাহা পরিয়াই আসিয়াছে। গায়ে জামা নাই, উত্তরীয়ের অবকাশ দিয়া তাহার প্রকাণ্ড দেহ দেখা যাইতেছে।
পূর্বে হইলে ইংরাজ ডাক্তার দেখিবামাত্র গোরার মনে আপনিই একটা বিদ্বেষ উৎপন্ন হইত। আজ যখন ডাক্তার রোগীকে পরীক্ষা করিতেছিল তখন গোরা তাহার প্রতি বিশেষ একটা ঔৎসুক্যের সহিত দৃষ্টিপাত করিল। নিজের মনকে বার বার করিয়া প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করিতে লাগিল, ‘এই লোকটাই কি এখানে আমার সকলের চেয়ে আত্মীয়?’
ডাক্তার পরীক্ষা করিয়া ও প্রশ্ন করিয়া কহিল, “কই, বিশেষ তো কোনো মন্দ লক্ষণ দেখি না। নাড়ীও শঙ্কাজনক নহে এবং শরীরযন্ত্রেরও কোনো বিকৃতি ঘটে নাই। যে উপসর্গ ঘটিয়াছে সাবধান হইলেই তাহার পুনরাবৃত্তি হইবে না।”
ডাক্তার বিদায় হইয়া গেলে কিছু না বলিয়া গোরা চৌকি হইতে উঠিবার উপক্রম করিল।
আনন্দময়ী ডাক্তারের আগমনে পাশের ঘরে চলিয়া গিয়াছিলেন। তিনি দ্রুত আসিয়া গোরার হাত চাপিয়া ধরিয়া কহিলেন, “বাবা, গোরা, আমার উপর তুই রাগ করিস নে— তা হলে আমি আর বাঁচব না!”
গোরা কহিল, “তুমি এতদিন আমাকে বল নি কেন? বললে তোমার কোনো ক্ষতি হত না।”