গোরা
কোনো কাজ দিয়াই তাহা সে পূরণ করিতে পারিতেছে না। শুধু সে নিজে নহে, তাহার সমস্ত কাজও যেন ঊর্ধ্বের দিকে হাত বাড়াইয়া বলিতেছে— একটা আলো চাই, উজ্জ্বল আলো, সুন্দর আলো! যেন আর-সমস্ত উপকরণ প্রস্তুত আছে, যেন হীরামানিক সোনারুপা দুর্মূল্য নয়, যেন লৌহ বজ্র বর্ম চর্ম দুর্লভ নয়— কেবল আশা ও সান্ত্বনায় উদ্‌ভাসিত স্নিগ্ধসুন্দর অরুণরাগমণ্ডিত আলো কোথায়? যাহা আছে তাহাকে আরো বাড়াইয়া তুলিবার জন্য কোনো প্রয়াসের প্রয়োজন নাই, কিন্তু তাহাকে সমুজ্জ্বল করিয়া, লাবণ্যময় করিয়া, প্রকাশিত করিয়া তুলিবার যে অপেক্ষা আছে।

বিনয় যখন বলিল, ‘কোনো কোনো মাহেন্দ্রক্ষণে নরনারীর প্রেমকে আশ্রয় করিয়া একটি অনির্বচনীয় অসামান্যতা উদ্‌ভাসিত হইয়া উঠে’ তখন গোরা পূর্বের ন্যায় সে কথাকে হাসিয়া উড়াইয়া দিতে পারিল না। গোরা মনে মনে স্বীকার করিল তাহা সামান্য মিলন নহে, তাহা পরিপূর্ণতা, তাহার সংস্রবে সকল জিনিসেরই মূল্য বাড়িয়া যায়; তাহা কল্পনাকে দেহ দান করে, ও দেহকে প্রাণে পূর্ণ করিয়া তোলে; তাহা প্রাণের মধ্যে প্রাণন ও মনের মধ্যে মননকে কেবল যে দ্বিগুণিত করে তাহা নহে, তাহাকে একটি নূতন রসে অভিষিক্ত করিয়া দেয়।

বিনয়ের সঙ্গে আজ সামাজিক বিচ্ছেদের দিনে বিনয়ের হৃদয় গোরার হৃদয়ের ’পরে একটি অখণ্ড একতান সংগীত বাজাইয়া দিয়া গেল। বিনয় চলিয়া গেল, বেলা বাড়িতে লাগিল, কিন্তু সে সংগীত কোনোমতেই থামিতে চাহিল না। সমুদ্রগামিনী দুই নদী একসঙ্গে মিলিলে যেমন হয়, তেমনি বিনয়ের প্রেমের ধারা আজ গোরার প্রেমের উপরে আসিয়া পড়িয়া তরঙ্গের দ্বারা তরঙ্গকে মুখরিত করিতে লাগিল। গোরা যাহাকে কোনোপ্রকারে বাধা দিয়া, আড়াল দিয়া, ক্ষীণ করিয়া নিজের অগোচরে রাখিবার চেষ্টা করিতেছিল, তাহাই আজ কূল ছাপাইয়া আপনাকে সুস্পষ্ট ও প্রবল মূর্তিতে ব্যক্ত করিয়া দিল। তাহাকে অবৈধ বলিয়া নিন্দা করিবে, তাহকে তুচ্ছ বলিয়া অবজ্ঞা করিবে, এমন শক্তি আজ গোরার রহিল না।

সমস্ত দিন এমন করিয়া কাটিল; অবশেষে অপরাহ্ন যখন সায়াহ্নে বিলীন হইতে চলিয়াছে তখন গোরা একখানা চাদর পাড়িয়া লইয়া কাঁধের উপর ফেলিয়া পথের মধ্যে বাহির হইয়া পড়িল। গোরা কহিল, ‘যে আমারই তাহাকে আমি লইব। নইলে পৃথিবীতে আমি অসম্পূর্ণ, আমি ব্যর্থ হইয়া যাইব।’

সমস্ত পৃথিবীর মাঝখানে সুচরিতা তাহারই আহ্বানের জন্য অপেক্ষা করিয়া আছে, ইহাতে গোরার মনে লেশমাত্র সংশয় রহিল না। আজই, এই সন্ধ্যাতেই, এই অপেক্ষাকে সে পূর্ণ করিবে।

জনাকীর্ণ কলিকাতার রাস্তা দিয়া গোরা বেগে চলিয়া গেল। কেহই যেন, কিছুতেই যেন, তাহাকে স্পর্শ করিল না। তাহার মন তাহার শরীরকে অতিক্রম করিয়া একাগ্র হইয়া কোথায় চলিয়া গিয়াছে।

সুচরিতার বাড়ির সম্মুখে আসিয়া গোরা যেন হঠাৎ সচেতন হইয়া থামিয়া দাঁড়াইল। এতদিন আসিয়াছে কখনো দ্বার বন্ধ দেখে নাই, আজ দেখিল দরজা খোলা নহে। ঠেলিয়া দেখিল, ভিতর হইতে বন্ধ। দাঁড়াইয়া একটু চিন্তা করিল; তাহার পরে দ্বারে আঘাত করিয়া দুই-চারি বার শব্দ করিল।

বেহারা দ্বার খুলিয়া বাহির হইয়া আসিল। সে সন্ধ্যার অস্পষ্ট আলোকে গোরাকে দেখিতেই কোনো প্রশ্নের অপেক্ষা না করিয়াই কহিল, দিদিঠাকরুন বাড়িতে নাই।

কোথায়?

তিনি ললিতাদিদির বিবাহের আয়োজনে কয় দিন হইতে অন্যত্র ব্যাপৃত রহিয়াছেন।

ক্ষণকালের জন্য গোরা মনে করিল সে বিনয়ের বিবাহসভাতেই যাইবে। এমন সময় বাড়ির ভিতর হইতে একটি অপরিচিত বাবু বাহির হইয়া কহিল, “কী মহাশয়, কী চান?”