চোখের বালি

আবার একবার বিনোদিনীর দ্বারে আঘাত পড়িল। প্রথমে সে বিরক্ত হইয়া কোনো উত্তর করিল না– তাহার পরে আবার বার বার আঘাত করিতেই বিনোদিনী জ্বলন্ত রোষে সবলে দ্বার খুলিয়া কহিল, “কেন তুমি আমাকে বার বার বিরক্ত করিতে আসিতেছ।” কথা শেষ না হইতেই বিনোদিনী দেখিল, বিহারী দাঁড়াইয়া আছে।

ঘরের মধ্যে মহেন্দ্র আছে কি না, দেখিবার জন্য বিহারী একবার ভিতরে চাহিয়া দেখিল। দেখিল, শয়নঘরে শুষ্ক ফুল এবং ছিন্ন মালা ছড়ানো। তাহার মন নিমেষের মধ্যেই প্রবলবেগে বিমুখ হইয়া গেল। বিহারী যখন দূরে ছিল, তখন বিনোদিনীর জীবনযাত্রা সম্বন্ধে কোনো সন্দেহজনক চিত্র যে তাহার মনে উদয় হয় নাই তাহা নহে, কিন্তু কল্পনার লীলা সে চিত্রকে ঢাকিয়াও একটি উজ্জ্বল মোহিনীচ্ছবি দাঁড় করাইয়াছিল। বিহারী যখন বাগানে প্রবেশ করিতেছিল তখন তাহার হৃৎকম্প হইতেছিল– পাছে কল্পনাপ্রতিমায় অকস্মাৎ আঘাত লাগে, এইজন্য তাহার চিত্ত সংকুচিত হইতেছিল। বিহারী বিনোদিনীর শয়নগৃহের দ্বারে সম্মুখে দাঁড়াইবামাত্র সেই আঘাতটাই লাগিল।

দূরে থাকিয়া বিহারী একসময় মনে করিয়াছিল, সে আপনার প্রেমাভিষেকে বিনোদিনীর জীবনের সমস্ত পঙ্কিলতা অনায়াসে ধৌত করিয়া লইতে পারিবে। কাছে আসিয়া দেখিল, তাহা সহজ নহে– মনের মধ্যে করুণার বেদনা আসিল কই। হঠাৎ ঘৃণার তরঙ্গ উঠিয়া তাহাকে অভিভূত করিয়া দিল। বিনোদিনীকে বিহারী অত্যন্ত মলিন দেখিল।

এক মুহূর্তেই বিহারী ফিরিয়া দাঁড়াইয়া “মহেন্দ্র” “মহেন্দ্র” করিয়া ডাকিল।

এই অপমান পাইয়া বিনোদিনী নম্রমৃদুস্বরে কহিল, “মহেন্দ্র নাই, মহেন্দ্র শহরে গেছে।”

বিহারী চলিয়া যাইতে উদ্যত হইলে বিনোদিনী কহিল, “বিহারী-ঠাকুরপো, তোমার পায়ে ধরি, একটুখানি তোমাকে বসিতে হইবে।”

বিহারী কোনো মিনতি শুনিবে না মনে করিয়াছিল, একেবারে এই ঘৃণার দৃশ্য হইতে এখনই নিজেকে দূরে লইয়া যাইবে স্থির করিয়াছিল, কিন্তু বিনোদিনীর করুণ অনুনয়স্বর শুনিবামাত্র ক্ষণকালের জন্য তাহার পা যেন আর উঠিল না।

বিনোদিনী কহিল, “আজ যদি তুমি বিমুখ হইয়া এমন করিয়া চলিয়া যাও, তবে আমি তোমারই শপথ করিয়া বলিতেছি, আমি মরিব।”

বিহারী তখন ফিরিয়া দাঁড়াইয়া কহিল, “বিনোদিনী, তোমার জীবনের সঙ্গে আমাকে তুমি জড়াইবার চেষ্টা করিতেছ কেন। আমি তোমার কী করিয়াছি। আমি তো কখনো তোমার পথে দাঁড়াই নাই, তোমার সুখদুঃখে হস্তক্ষেপ করি নাই।” বিনোদিনী কহিল, “তুমি আমার কতখানি অধিকার করিয়াছ, তাহা একবার তোমাকে জানাইয়াছি– তুমি বিশ্বাস কর নাই। তবু আজ আবার তোমার বিরাগের মুখে সেই কথাই জানাইতেছি। তুমি তো আমাকে না বলিয়া জানাইবার, লজ্জা করিয়া জানাইবার, সময় দাও নাই। তুমি আমাকে ঠেলিয়া ফেলিয়াছ, তবু আমি তোমার পা ধরিয়া বলিতেছি, আমি তোমাকে– ”

বিহারী বাধা দিয়া কহিল, “সে কথা আর বলিয়ো না, মুখে আনিয়ো না। সে কথা বিশ্বাস করিবার জো নাই।”

বিনোদিনী। সে কথা ইতর লোকে বিশ্বাস করিতে পারে না, কিন্তু তুমি করিবে। সেইজন্য একবার আমি তোমাকে বসিতে বলিতেছি।

বিহারী। আমি বিশ্বাস করি বা না করি, তাহাতে কী আসে যায়। তোমার জীবন যেমন চলিতেছে, তেমনি চলিবে তো।

বিনোদিনী। আমি জানি তোমার ইহাতে কিছুই আসিবে-যাইবে না। আমার ভাগ্য এমন যে, তোমার সম্মানরক্ষা করিয়া তোমার পাশে দাঁড়াইবার আমার কোনো উপায় নাই। চিরকাল তোমা হইতে আমাকে দূরেই থাকিতে হইবে। আমার মন তোমার কাছে এই দাবিটুকু কেবল ছাড়িতে পারে না যে, আমি যেখানে থাকি আমাকে তুমি একটুকু মাধুর্যের সঙ্গে ভাবিবে। আমি জানি,