প্রকল্প সম্বন্ধেপ্রকল্প রূপায়ণেরবীন্দ্র-রচনাবলীজ্ঞাতব্য বিষয়পাঠকের চোখেআমাদের লিখুনডাউনলোডঅন্যান্য রচনা-সম্ভার |
মহেন্দ্রের মোহ দ্বিগুণ হইয়া উঠিল। সে অবরুদ্ধকণ্ঠে বলিয়া উঠিল, “বিনোদ, আমি যমুনার ধারে অপেক্ষা করিয়া বসিয়া ছিলাম, তুমি যে এখানে অপেক্ষা করিয়া আছ, আকাশের চাঁদ আমাকে সেই সংবাদ দিল, তাই আমি চলিয়া আসিলাম।”
এই কথা বলিয়া মহেন্দ্র বিছানায় বসিবার জন্য অগ্রসর হইল।
বিনোদিনী তাড়াতাড়ি চকিত হইয়া উঠিয়া দক্ষিণবাহু প্রসারিত করিয়া কহিল, “যাও যাও, তুমি এ বিছানায় বসিয়ো না।”
ভরাপালের নৌকা চড়ায় ঠেকিয়া গেল– মহেন্দ্র স্তম্ভিত হইয়া দাঁড়াইল। অনেকক্ষণ তাহার মুখ দিয়া কথা বাহির হইল না। পাছে মহেন্দ্র নিষেধ না মানে, এইজন্য বিনোদিনী শয্যা ছাড়িয়া আসিয়া দাঁড়াইল।
মহেন্দ্র কহিল, “তবে তুমি কাহার জন্য সাজিয়াছ। কাহার জন্য অপেক্ষা করিতেছ।”
বিনোদিনী আপনার বুক চাপিয়া ধরিয়া কহিল, “যাহার জন্য সাজিয়াছি, সে আমার অন্তরের ভিতরে আছে।”
মহেন্দ্র কহিল, “সে কে। সে বিহারী?”
বিনোদিনী কহিল, “তাহার নাম তুমি মুখে উচ্চারণ করিয়ো না।”
মহেন্দ্র। তাহারই জন্য তুমি পশ্চিমে ঘুরিয়া বেড়াইতেছ?
বিনোদিনী। তাহারই জন্য।
মহেন্দ্র। তাহারই জন্য তুমি এখানে অপেক্ষা করিয়া আছ?
বিনোদিনী। তাহারই জন্য।
মহেন্দ্র। তাহার ঠিকানা জানিয়াছ?
বিনোদিনী। জানি না, কিন্তু যেমন করিয়া হউক, জানিবই।
মহেন্দ্র। কোনোমতেই জানিতে দিব না।
বিনোদিনী। না যদি জানিতে দাও, আমার হৃদয় হইতে তাহাকে কোনোমতেই বাহির করিতে পারিবে না।
এই বলিয়া বিনোদিনী চোখ বুজিয়া আপনার হৃদয়ের মধ্যে বিহারীকে একবার অনুভব করিয়া লইল। মহেন্দ্র সেই পুষ্পাভরণা বিরহবিধুরমূর্তি বিনোদিনীর দ্বারা একই কালে প্রবলবেগে আকৃষ্ট ও প্রত্যাখ্যাত হইয়া হঠাৎ ভীষণ হইয়া উঠিল– মুষ্টি বদ্ধ করিয়া কহিল, “ছুরি দিয়া কাটিয়া তোমার বুকের ভিতর হইতে তাহাকে বাহির করিব।”
বিনোদিনী অবিচলিতমুখে কহিল, “তোমার ভালোবাসার চেয়ে তোমার ছুরি আমার হৃদয়ে সহজে প্রবেশ করিবে।”
মহেন্দ্র। তুমি আমাকে ভয় কর না কেন, এখানে তোমার রক্ষক কে আছে।
বিনোদিনী। তুমি আমার রক্ষক আছ। তোমার নিজের কাছ হইতে তুমি আমাকে রক্ষা করিবে।
মহেন্দ্র। এইটুকু শ্রদ্ধা, এইটুকু বিশ্বাস, এখনো বাকি আছে!
বিনোদিনী। তা না হইলে আমি আত্মহত্যা করিয়া মরিতাম, তোমার সঙ্গে বাহির হইতাম না।
মহেন্দ্র। কেন মরিলে না– ঐটুকু বিশ্বাসের ফাঁসি আমার গলায় জড়াইয়া আমাকে দেশদেশান্তরে টানিয়া মারিতেছ কেন। তুমি মরিলে কত মঙ্গল হইত ভাবিয়া দেখো।
বিনোদিনী। তাহা জানি, কিন্তু যতদিন বিহারীর আশা আছে, ততদিন আমি মরিতে পারিব না।
মহেন্দ্র। যতদিন তুমি না মরিবে, ততদিন আমার প্রত্যাশাও মরিবে না– আমিও নিষ্কৃতি পাইব না। আমি আজ হইতে ভগবানের কাছে সর্বান্তঃকরণে তোমার মৃত্যু কামনা করি। তুমি আমারও হইয়ো না, তুমি বিহারীরও হইয়ো না। তুমি যাও। আমাকে ছুটি দাও। আমার মা কাঁদিতেছেন, আমার স্ত্রী কাঁদিতেছে– তাঁহাদের অশ্রু আমাকে দূর হইতে দগ্ধ করিতেছে। তুমি না মরিলে,