গোরা
অনার্য জাতি হিন্দুসমাজের মধ্যে প্রবেশ করে একটা গৌরব বোধ করত। এ দিকে মুসলমানের আমলে দেশের প্রায় সর্বত্রই হিন্দু রাজা ও জমিদারের প্রভাব যথেষ্ট ছিল, এইজন্যে সমাজ থেকে কারো সহজে বেরিয়ে যাবার বিরুদ্ধে শাসন ও বাধার সীমা ছিল না। এখন ইংরেজ-অধিকারে সকলকেই আইনের দ্বারা রক্ষা করছে, সেরকম কৃত্রিম উপায়ে সমাজের দ্বার আগলে থাকবার জো এখন আর তেমন নেই। সেইজন্য কিছুকাল থেকে কেবলই দেখা যাচ্ছে, ভারতবর্ষে হিন্দু কমছে আর মুসলমান বাড়ছে। এরকমভাবে চললে ক্রমে এ দেশ মুসলমান-প্রধান হয়ে উঠবে, তখন একে হিন্দুস্থান বলাই অন্যায় হবে।”

সুচরিতা ব্যথিত হইয়া উঠিয়া কহিল, “বাবা, এটা কি নিবারণ করাই আমাদের সকলের উচিত হবে না? আমরাও কি হিন্দুকে পরিত্যাগ করে তার ক্ষয়কে বাড়িয়ে তুলব? এখনই তো তাকে প্রাণপণ শক্তিতে আঁকড়ে থাকবার সময়।”

পরেশবাবু সস্নেহে সুচরিতার পিঠে হাত বুলাইয়া কহিলেন, “আমরা ইচ্ছা করলেই কি কাউকে আঁকড়ে ধরে বাঁচিয়ে রাখতে পারি? রক্ষা পাবার জন্য একটা জাগতিক নিয়ম আছে— সেই স্বভাবের নিয়মকে যে পরিত্যাগ করে সকলেই তাকে স্বভাবতই পরিত্যাগ করে। হিন্দুসমাজ মানুষকে অপমান করে, বর্জন করে, এইজন্যে এখনকার দিনে আত্মরক্ষা করা তার পক্ষে প্রত্যহই কঠিন হয়ে উঠছে। কেননা, এখন তো আর সে আড়ালে বসে থাকতে পারবে না— এখন পৃথিবীর চার দিকের রাস্তা খুলে গেছে, চার দিক থেকে মানুষ তার উপরে এসে পড়ছে; এখন শাস্ত্র-সংহিতা দিয়ে বাঁধ বেঁধে প্রাচীর তুলে সে আপনাকে সকলের সংস্রব থেকে কোনোমতে ঠেকিয়ে রাখতে পারবে না। হিন্দুসমাজ এখনো যদি নিজের মধ্যে সংগ্রহ করবার শক্তি না জাগায়, ক্ষয়রোগকেই প্রশ্রয় দেয়, তা হলে বাহিরের মানুষের এই অবাধ সংস্রব তার পক্ষে একটা সাংঘাতিক আঘাত হয়ে দাঁড়াবে।”

সুচরিতা বেদনার সহিত বলিয়া উঠিল, “আমি এ-সব কিছু বুঝি নে, কিন্তু এই যদি সত্য হয় একে আজ সবাই ত্যাগ করতে বসেছে, তা হলে এমন দিনে একে আমি তো ত্যাগ করতে বসব না। আমরা এর দুর্দিনের সন্তান বলেই তো এর শিয়রের কাছে আমাদের আজ দাঁড়িয়ে থাকতে হবে।”

পরেশবাবু কহিলেন, “মা, তোমার মনে যে ভাব জেগে উঠেছে আমি তার বিরুদ্ধে কোনো কথা তুলব না। তুমি উপাসনা করে মন স্থির করে তোমার মধ্যে যে সত্য আছে, যে শ্রেয়ের আদর্শ আছে, তারই সঙ্গে মিলিয়ে সব কথা বিচার করে দেখো— ক্রমে ক্রমে তোমার কাছে সমস্ত পরিষ্কার হয়ে উঠবে। যিনি সকলের চেয়ে বড়ো তাঁকে দেশের কাছে কিংবা কোনো মানুষের কাছে খাটো কোরো না— তাতে তোমারও মঙ্গল না, দেশেরও না। আমি এই মনে করে একান্তচিত্তে তাঁরই কাছে আত্মসমর্পণ করতে চাই; তা হলেই দেশের এবং প্রত্যেক লোকের সম্বন্ধেই আমি সহজেই সত্য হতে পারব।”

এমন সময় একজন লোক পরেশবাবুর হাতে একখানি চিঠি আনিয়া দিল। পরেশবাবু কহিলেন, “চশমাটা নেই, আলোও কমে গেছে— চিঠিখানা পড়ে দেখো দেখি।”

সুচরিতা চিঠি পড়িয়া তাঁহাকে শুনাইল। ব্রাহ্মসমাজের এক কমিটি হইতে তাঁহার কাছে পত্রটি আসিয়াছে, নীচে অনেকগুলি ব্রাহ্মের নাম সহি করা আছে। পত্রের মর্ম এই যে, পরেশ অব্রাহ্ম মতে তাঁহার কন্যার বিবাহে সম্মতি দিয়াছেন এবং সেই বিবাহে নিজেও যোগ দিতে প্রস্তুত হইয়াছেন। এরূপ অবস্থায় ব্রাহ্মসমাজ কোনোমতেই তাঁহাকে সভ্যশ্রেণীর মধ্যে গণ্য করিতে পারেন না। নিজের পক্ষে যদি তাঁহার কিছু বলিবার থাকে তবে আগামী রবিবারের পূর্বে সে সম্বন্ধে কমিটির হস্তে তাঁহার পত্র আসা চাই— সেইদিন আলোচনা হইয়া অধিকাংশের মতে চূড়ান্ত নিষ্পত্তি হইবে।

পরেশ চিঠিখানি লইয়া পকেটে রাখিলেন। সুচরিতা তাহার স্নিগ্ধ হস্তে তাঁহার ডান হাতখানি ধরিয়া নিঃশব্দে তাঁহার সঙ্গে সঙ্গে বেড়াইতে লাগিল। ক্রমে সন্ধ্যার অন্ধকার ঘনীভূত হইয়া আসিল, বাগানের দক্ষিণ পার্শ্বের গলিতে রাস্তার একটি আলো জ্বলিয়া উঠিল। সুচরিতা মৃদুকণ্ঠে কহিল, “বাবা, তোমার উপাসনার সময় হয়েছে, আমি তোমার সঙ্গে আজ উপাসনা করব।” এই বলিয়া