প্রকল্প সম্বন্ধেপ্রকল্প রূপায়ণেরবীন্দ্র-রচনাবলীজ্ঞাতব্য বিষয়পাঠকের চোখেআমাদের লিখুনডাউনলোডঅন্যান্য রচনা-সম্ভার |
এমন সময় বিহারী হঠাৎ চমকিয়া উঠিয়া দেখিল, সম্মুখে অন্নপূর্ণা। শশব্যস্ত হইয়া উঠিয়া পড়িল– দুই হাতে তাঁহার পা চাপিয়া ধরিয়া ভূতলে মাথা রাখিয়া প্রণাম করিল। অন্নপূর্ণা তাঁহার দক্ষিণ হস্ত দিয়া পরমস্নেহে বিহারীর মাথা ও গা স্পর্শ করিলেন। অশ্রুজড়িতস্বরে কহিলেন, “বিহারী, তুই এত রোগা হইয়া গেছিস কেন।”
বিহারী কহিল, “কাকীমা, তোমার স্নেহ ফিরিয়া পাইবার জন্য।”
শুনিয়া অন্নপূর্ণার চোখ দিয়া ঝরঝর করিয়া জল পড়িতে লাগিল। বিহারী ব্যস্ত হইয়া কহিল, “কাকীমা, তোমার এখনো খাওয়া হয় নাই?”
অন্নপূর্ণা কহিলেন, “না, এখনো আমার সময় হয় নাই।”
বিহারী কহিল, “চলো, আমি রাঁধিবার জোগাড় করিয়া দিই গে। আজ অনেক দিন পরে তোমার হাতের রান্না এবং তোমার পাতের প্রসাদ খাইয়া বাঁচিব।”
মহেন্দ্র-আশার সম্বন্ধে বিহারী কোনো কথাই উত্থাপন করিল না। অন্নপূর্ণা একদিন স্বহস্তে বিহারীর নিকটে সেদিককার দ্বার রুদ্ধ করিয়া দিয়াছেন। অভিমানের সহিত সেই নিষ্ঠুর নিষেধ সে পালন করিল।
আহারান্তে অন্নপূর্ণা কহিলেন, “নৌকা ঘাটেই প্রস্তুত আছে, বিহারী, এখন একবার কলিকাতায় চল্।”
বিহারী কহিল, “কলিকাতায় আমার কোন্ প্রয়োজন।”
অন্নপূর্ণা কহিলেন, “দিদির বড়ো অসুখ, তিনি তোকে দেখিতে চাহিয়াছেন।”
শুনিয়া বিহারী চকিত হইয়া উঠিল। জিজ্ঞাসা করিল, “মহিনদা কোথায়।”
অন্নপূর্ণা কহিলেন, “সে কলিকাতায় নাই, পশ্চিমে চলিয়া গেছে।”
শুনিয়া মুহূর্তে বিহারীর মুখ বিবর্ণ হইয়া গেল। সে চুপ করিয়া রহিল।
অন্নপূর্ণা জিজ্ঞাসা করিলেন, “তুই কি সকল কথা জানিস নে।”
বিহারী কহিল, “ কতকটা জানি, কিন্তু শেষ পর্যন্ত জানি না।”
তখন অন্নপূর্ণা বিনোদিনীকে লইয়া মহেন্দ্রের পশ্চিমে পলায়ন-বার্তা বলিলেন। বিহারীর চক্ষে তৎক্ষণাৎ জলস্থল-আকাশের সমস্ত রঙ বদলাইয়া গেল, তাহার কল্পনা-ভাণ্ডারের সমস্ত সঞ্চিত রস মুহূর্তে তিক্ত হইয়া উঠিল। ‘মায়াবিনী বিনোদিনী কি সেদিনকার সন্ধ্যাবেলায় আমাকে লইয়া খেলা করিয়া গেল। তাহার ভালোবাসার আত্মসমর্পণ সমস্তই ছলনা! সে তাহার গ্রাম ত্যাগ করিয়া নির্লজ্জভাবে মহেন্দ্রের সঙ্গে একাকিনী পশ্চিমে চলিয়া গেল! ধিক্ তাহাকে, এবং ধিক্ আমাকে যে-আমি মূঢ়– তাহাকে এক মুহূর্তের জন্যও বিশ্বাস করিয়াছিলাম।”
হায় মেঘাচ্ছন্ন আষাঢ়ের সন্ধ্যা, হায় গতবৃষ্টি পূর্ণিমার রাত্রি, তোমাদের ইন্দ্রজাল কোথায় গেল।