গোরা

বলিয়া আনন্দময়ী চোখের কোণ হইতে এক ফোঁটা অশ্রু মুছিয়া ফেলিলেন বিনয়ের জন্য গোরার মনের মধ্যে যে গভীর বেদনা ছিল তাহা আলোড়িত হইয়া উঠিল। তবু সে বলিল, “মা, তুমি সমাজে আছ এবং সমাজের কাছে তুমি ঋণী, এ কথা তোমাকে মনে রাখতে হবে।”

আনন্দময়ী কহিলেন, “গোরা, আমি তো তোমাকে বার বার বলেছি, সমাজের সঙ্গে আমার যোগ অনেক দিন থেকেই কেটে গেছে। সেজন্যে সমাজ আমাকে ঘৃণা করে, আমিও তার থেকে দূরে থাকি।”

গোরা কহিল, “ মা, তোমার এই কথায় আমি সব চেয়ে আঘাত পাই।”

আনন্দময়ী তাঁহার অশ্রু-ছলছল স্নিগ্ধদৃষ্টিদ্বারা গোরার সর্বাঙ্গ যেন স্পর্শ করিয়া কহিলেন, “বাছা, ঈশ্বর জানেন তোকে এ আঘাত থেকে বাঁচাবার সাধ্য আমার নেই।”

গোরা উঠিয়া দাঁড়াইয়া কহিল, “তা হলে আমাকে কী করতে হবে তোমাকে বলি। আমি বিনয়ের কাছে চললুম— তাকে আমি বলব তোমাকে তার বিবাহ-ব্যাপারে জড়িত করে সমাজের সঙ্গে তোমার বিচ্ছেদকে সে যেন আর বাড়িয়ে না তোলে, কেননা, এ তার পক্ষে অত্যন্ত অন্যায় এবং স্বার্থপরতার কাজ হবে।”

আনন্দময়ী হাসিয়া কহিলেন, “আচ্ছা, তুই যা করতে পারিস করিস, তাকে বল্ গে যা— তার পরে আমি দেখব এখন।”

গোরা চলিয়া গেলে আনন্দময়ী অনেকক্ষণ বসিয়া চিন্তা করিলেন। তাহার পর ধীরে ধীরে উঠিয়া তাঁহার স্বামীর মহলে চলিয়া গেলেন।

আজ একাদশী সুতরাং আজ কৃষ্ণদয়ালের স্বপাকের কোনো আয়োজন নাই। তিনি ঘেরণ্ডসংহিতার একটি নূতন বাংলা অনুবাদ পাইয়াছিলেন; সেইটি হাতে লইয়া একখানি মৃগচর্মের উপর বসিয়া পাঠ করিতেছিলেন।

আনন্দময়ীকে দেখিয়া তিনি ব্যস্ত হইয়া উঠিলেন। আনন্দময়ী তাঁহার সহিত যথেষ্ট দূরত্ব রাখিয়া ঘরের চৌকাঠের উপর বসিয়া কহিলেন, “ দেখো, বড়ো অন্যায় হচ্ছে।”

কৃষ্ণদয়াল সাংসারিক ন্যায়-অন্যায়ের বাহিরে আসিয়া পড়িয়াছিলেন; এইজন্য উদাসীনভাবে জিজ্ঞাসা করিলেন, “কী অন্যায়?”

আনন্দময়ী কহিলেন, “গোরাকে কিন্তু আর একদিনও ভুলিয়ে রাখা উচিত হচ্ছে না, ক্রমেই বাড়াবাড়ি হয়ে পড়ছে।”

গোরা যেদিন প্রায়শ্চিত্তের কথা তুলিয়াছিল সেদিন কৃষ্ণদয়ালের মনে এ কথা উঠিয়াছিল; তাহার পরে যোগসাধনার নানাপ্রকার প্রক্রিয়ার মধ্যে পড়িয়া সে কথা চিন্তা করিবার অবকাশ পান নাই।

আনন্দময়ী কহিলেন, “শশিমুখীর বিয়ের কথা হচ্ছে; বোধ হয় এই ফাল্গুন মাসেই হবে। এর আগে বাড়িতে যতবার সামাজিক ক্রিয়াকর্ম হয়েছে আমি কোনো-না-কোনো ছুতায় গোরাকে সঙ্গে করে অন্য জায়গায় গেছি। তেমন বড়ো কোনো কাজও তো এর মধ্যে হয় নি। কিন্তু এবার শশীর বিবাহে ওকে নিয়ে কী করবে বলো। অন্যায় রোজই বাড়ছে— আমি ভগবানের কাছে দুবেলা হাত জোড় করে মাপ চাচ্ছি, তিনি শাস্তি যা দিতে চান সব আমাকেই যেন দেন। কিন্তু আমার কেবল ভয় হচ্ছে, আর বুঝি ঠেকিয়ে রাখতে পারা যাবে না, গোরাকে নিয়ে বিপদ হবে। এইবার আমাকে অনুমতি দাও, আমার কপালে যা থাকে, ওকে আমি সব কথা খুলে বলি।”

কৃষ্ণদয়ালের তপস্যা ভাঙিবার জন্য ইন্দ্রদেব এ কী বিঘ্ন পাঠাইতেছেন! তপস্যাও সম্প্রতি খুব ঘোরতর হইয়া উঠিয়াছে; নিশ্বাস লইয়া অসাধ্য সাধন হইতেছে, আহারের মাত্রাও ক্রমে এতটা কমিয়াছে যে পেটকে পিঠের সহিত এক করিবার পণ রক্ষা হইতে আর বড়ো বিলম্ব নাই। এমন সময় এ কী উৎপাত!

কৃষ্ণদয়াল কহিলেন, “তুমি কি পাগল হয়েছ! এ কথা আজ প্রকাশ হলে আমাকে যে বিষম জবাবদিহিতে পড়তে হবে।