চোখের বালি

মহেন্দ্র। তা না হইলে এই অসহ্য গরমের সময় কি মানুষ শখ করিয়া পশ্চিমে বেড়াইতে যায়।

বিনোদিনী। আমার কথা কিছু বলিলেন না কি।

মহেন্দ্র। বলিবার আর কী আছে। এই লও বিহারীর চিঠি।

বলিয়া চিঠিখানা বিনোদিনীর হাতে দিয়া মহেন্দ্র তীব্রদৃষ্টিতে তাহার মুখের ভাব নিরীক্ষণ করিতে লাগিল।

বিনোদিনী তাড়াতাড়ি চিঠি লইয়া দেখিল, খোলা চিঠি– লেফাফার উপরে তাহারই হস্তাক্ষরে বিহারীর নাম লেখা। লেফাফা হইতে বাহির করিয়া দেখিল, তাহারই লেখা সেই চিঠি। উলটাইয়া পালটাইয়া কোথাও বিহারীর লেখা জবাব কিছুই দেখিতে পাইল না।

একটুখানি চুপ করিয়া থাকিয়া বিনোদিনী মহেন্দ্রকে জিজ্ঞাসা করিল, “চিঠিখানা তুমি পড়িয়াছ?”

বিনোদিনীর মুখের ভাব দেখিয়া মহেন্দ্রের মনে ভয়ের সঞ্চার হইল। সে ফস করিয়া মিথ্যা কথা কহিল, “না।”

বিনোদিনী চিঠিখানা টুকরা-টুকরা করিয়া ছিঁড়িয়া, পুনরায় তাহা কুটিকুটি করিয়া জানালার বাহিরে ফেলিয়া দিল।

মহেন্দ্র কহিল, “আমি বাড়ি যাইতেছি।”

বিনোদিনী তাহার কোনো উত্তর দিল না।

মহেন্দ্র। তুমি যেমন ইচ্ছা প্রকাশ করিয়াছ, আমি তাহাই করিব। সাত দিন আমি বাড়িতে থাকিব। কালেজে আসিবার সময় প্রত্যহ একবার এখানকার সমস্ত বন্দোবস্ত করিয়া খেমির হাতে দিয়া যাইব। দেখা করিয়া তোমাকে বিরক্ত করিব না।

বিনোদিনী মহেন্দ্রের কোনো কথা শুনিতে পাইল কি না কে জানে, কিন্তু কোনো উত্তর করিল না– খোলা জানালার বাহিরে অন্ধকার আকাশে চাহিয়া রহিল।

মহেন্দ্র তাহার জিনিসপত্র লইয়া বাহির হইয়া গেল।

বিনোদিনী শূন্যগৃহে অনেকক্ষণ আড়ষ্টের মতো বসিয়া থাকিয়া অবশেষে নিজেকে যেন প্রাণপণ বলে সচেতন করিবার জন্য বক্ষের কাপড় ছিঁড়িয়া আপনাকে নিষ্ঠুরভাবে আঘাত করিতে লাগিল।

খেমি শব্দ শুনিয়া ব্যস্ত হইয়া কহিল, “বউঠাকরুন, করিতেছ কী।”

“তুই যা এখান থেকে” বলিয়া গর্জন করিয়া উঠিয়া বিনোদিনী খেমিকে ঘর হইতে বাহির করিয়া দিল। তাহর পরে সশব্দে দ্বার রুদ্ধ করিয়া, দুই হাত মুঠা করিয়া, মাটিতে লুটাইয়া পড়িয়া, বাণাহত জন্তুর মতো আর্তস্বরে কাঁদিতে লাগিল। এইরূপে বিনোদিনী নিজেকে বিক্ষত পরিশ্রান্ত করিয়া মূর্ছিতের মতো মুক্ত বাতায়নের তলে সমস্ত রাত্রি পড়িয়া রহিল।

প্রাতঃকালে সূর্যালোক গৃহে প্রবেশ করিতেই তাহার হঠাৎ সন্দেহ হইল, বিহারী যদি না গিয়া থাকে, মহেন্দ্র যদি বিনোদিনীকে ভুলাইবার জন্য মিথ্যা বলিয়া থাকে। তৎক্ষণাৎ খেমিকে ডাকিয়া কহিল, “খেমি, তুই এখনই যা– বিহারী-ঠাকুরপোর বাড়ি গিয়া তাঁহাদের খবর লইয়া আয়।”

খেমি ঘণ্টাখানেক পরে ফিরিয়া আসিয়া কহিল, “বিহারীবাবুর বাড়ির সমস্ত জানালা দরজা বন্ধ। দরজায় ঘা দিতে ভিতর হইতে বেহারা বলিল, ‘বাবু বাড়িতে নাই, তিনি পশ্চিমে বেড়াইতে গিয়াছেন’।”

বিনোদিনীর মনে আর সন্দেহের কোনোই কারণ রহিল না।