চোখের বালি

বিনোদিনী ভূমিতে বসিয়া পুনরায় নিরুত্তরে সেলাই করিতে লাগিল।

মহেন্দ্র কিছুক্ষণ স্থিরভাবে তাহার মুখের দিকে চাহিয়া বলিয়া উঠিল, “নিষ্ঠুর, বিনোদ, তুমি নিষ্ঠুর! আমি অত্যন্ত হতভাগ্য যে, আমি তোমাকে ভালোবাসিয়াছি।”

বিনোদিনী সেলাইয়ে একটা ভুল করিয়া আলোর কাছে ধরিয়া তাহা বহুযত্নে পুনর্বার খুলিতে লাগিল। মহেন্দ্রের ইচ্ছা করিতে লাগিল, বিনোদিনীর ঐ পাষাণ হৃদয়টাকে নিজের কঠিন মুষ্টির মধ্যে সবলে চাপিয়া ভাঙিয়া ফেলে। এই নীরব নির্দয়তা ও অবিচলিত উপেক্ষাকে প্রবল আঘাত করিয়া যেন বাহুবলের দ্বারা পরাস্ত করিতে ইচ্ছা করে।

মহেন্দ্র ঘর হইতে বাহির হইয়া পুনরায় ফিরিয়া আসিল– কহিল, “আমি না থাকিলে এখানে একাকিনী তোমাকে কে রক্ষা করিবে।”

বিনোদিনী কহিল, “সেজন্য তুমি কিছুমাত্র ভয় করিয়ো না। পিসিমা খেমিকে ছাড়াইয়া দিয়াছেন, সে আজ আমার এখানে আসিয়া কাজ লইয়াছে। দ্বারে তালা দিয়া আমরা দুই স্ত্রীলোকে এখানে বেশ থাকিব।”

মনে মনে যতই রাগ হইতে লাগিল, বিনোদিনীর প্রতি মহেন্দ্রের আকর্ষণ ততই একান্ত প্রবল হইয়া উঠিল। ঐ অটল মূর্তিকে বজ্রবলে বক্ষে চাপিয়া ধরিয়া ক্লিষ্ট পিষ্ট করিয়া ফেলিতে ইচ্ছা করিতে লাগিল। সেই দারুণ ইচ্ছার হাত এড়াইবার জন্য মহেন্দ্র ছুটিয়া বাড়ি হইতে বাহির হইয়া গেল।

রাস্তায় ঘুরিতে ঘুরিতে মহেন্দ্র প্রতিজ্ঞা করিতে লাগিল, বিনোদিনীকে সে উপেক্ষার পরিবর্তে উপেক্ষা দেখাইবে। যে-অবস্থায় বিশ্বজগতে বিনোদিনীর একমাত্র নির্ভর মহেন্দ্র সে অবস্থাতেও মহেন্দ্রকে এমন নীরবে নির্ভয়ে, এমন সুদৃঢ় সুস্পষ্টভাবে প্রত্যাখ্যান– এতবড়ো অপমান কি কোনো পুরুষের ভাগ্যে কখনো ঘটিয়াছে। মহেন্দ্রের গর্ব চূর্ণ হইয়াও কিছুতেই মরিতে চাহিল না, সে কেবলই পীড়িত দলিত হইতে লাগিল। মহেন্দ্র কহিল, ‘আমি কি এতই অপদার্থ। আমার সম্বন্ধে এতবড়ো স্পর্ধা কী করিয়া তাহার মনে হইল। আমি ছাড়া এখন তাহার আর কে আছে।’

ভাবিতে ভাবিতে হঠাৎ মনে পড়িল– বিহারী। হঠাৎ এক মুহূর্তের জন্য তাহার বক্ষে সমস্ত রক্তপ্রবাহ যেন স্তব্ধ হইয়া গেল। বিহারীর উপরেই বিনোদিনী নির্ভর স্থাপন করিয়া আছে– আমি তাহার উপলক্ষমাত্র, আমি তাহার সোপান, তাহার পা রাখিবার, পদে-পদে পদাঘাত করিবার স্থান। সেই সাহসেই আমার প্রতি এত অবজ্ঞা! মহেন্দ্রের সন্দেহ হইল, বিহারীর সহিত বিনোদিনীর চিঠিপত্র চলিতেছে এবং বিনোদিনী তাহার কাছ হইতে কোনো আশ্বাস পাইয়াছে।

তখন মহেন্দ্র বিহারীর বাড়ির দিকে চলিল। যখন বিহারীর দ্বারে গিয়া ঘা দিল, তখন রাত্রি আর বড়ো অধিক নাই। অনেক ধাক্কার পর বেহারা ভিতর হইতে দরজা খুলিয়া দিয়া কহিল, “বাবুজি বাড়ি নাই।”

মহেন্দ্র চমকিয়া উঠিল। ভাবিল, ‘আমি যখন নির্বোধের মতো রাস্তায় রাস্তায় ছুটিয়া বেড়াইতেছি, বিহারী সেই অবকাশে বিনোদিনীর কাছে গেছে। এইজন্যই বিনোদিনী আমাকে এই রাত্রে এমন নির্দয়ভাবে অপমান করিয়াছে, এবং আমিও তাড়িত গর্দভের মতো ছুটিয়া চলিয়া আসিয়াছি।’

মহেন্দ্র তাহার পুরাতন পরিচিত বেহারাকে জিজ্ঞাসা করিল, “ভজু, বাবু কখন বাহির হইয়া গেছেন।”

ভজু কহিল, “সে আজ চার-পাঁচ দিন হইয়া গেছে। তিনি পশ্চিমে কোথায় বেড়াইতে গেছেন।”

শুনিয়া মহেন্দ্র বাঁচিয়া গেল। তাহার মনে হইল, ‘এইবার একটু শুইয়া আরামে ঘুমাই, আর সমস্ত রাত
ঘুরিয়া বেড়াইতে পারি না।’ বলিয়া উপরে উঠিয়া বিহারীর ঘরে কৌচের উপর শুইয়া তৎক্ষণাৎ ঘুমাইয়া পড়িল।

মহেন্দ্র যে-রাত্রে বিহারীর ঘরে আসিয়া উপদ্রব করিয়াছিল, তাহার পরদিনই বিহারী কোথায় যাইতে হইবে, কিছুই স্থির