চোখের বালি
সেখানে নিস্তব্ধ শান্তির মধ্যে বিহারী একলা কেদারায় বসিয়া আছে– হয়তো কাছে সেই ব্রাহ্মণ-বালক, সেই সুগোল সুন্দর গৌরবর্ণ আয়তনেত্র সরলমূর্তি ছেলেটি নিজের মনে ছবির বই লইয়া পাতা উলটাইতেছে– একে একে সমস্ত চিত্রটা মনে করিয়া স্নেহে প্রেমে বিনোদিনীর সর্বাঙ্গ পরিপূর্ণ পুলকিত হইয়া উঠিল। ইচ্ছা করিলে এখনই যাওয়া যায়, ইহাই মনে করিয়া বিনোদিনী ইচ্ছাকে বক্ষে তুলিয়া লইয়া খেলা করিতে লাগিল। আগে হইলে হয়তো সেই ইচ্ছা পূর্ণ করিতে সে অগ্রসর হইত; কিন্তু এখন অনেক কথা ভাবিতে হয়। এখন শুধু বাসনা চরিতার্থ করা নয়, উদ্দেশ্য সিদ্ধ করিতে হইবে। বিনোদিনী কহিল, ‘আগে দেখি বিহারী কিরূপ উত্তর দেয় তাহার পরে কোন্‌ পথে চলা আবশ্যক, স্থির করা যাইবে।’ কিছু না বুঝিয়া বিহারীকে বিরক্ত করিতে যাইতে তাহার আর সাহস হইল না।

এইরূপ ভাবিতে ভাবিতে যখন রাত্রি নয়টা-দশটা বাজিয়া গেল, তখন মহেন্দ্র ধীরে ধীরে আসিয়া উপস্থিত। কয়দিন অনিদ্রায় অনিয়মে অত্যন্ত উত্তেজিত অবস্থায় সে কাটাইয়াছে; আজ কৃতকার্য হইয়া বিনোদিনীকে বাসায় আনিয়া একেবারে অবসাদ ও শ্রান্তিতে তাহাকে যেন অভিভূত করিয়া দিয়াছে। আজ আর সংসারের সঙ্গে নিজের অবস্থার সঙ্গে লড়াই করিবার বল যেন তাহার নাই। তাহার সমস্ত ভারাক্রান্ত ভাবী জীবনের ক্লান্তি যেন তাহাকে আজ আগে হইতে আক্রমণ করিল।

রুদ্ধ দ্বারের কাছে দাঁড়াইয়া ঘা দিতে মহেন্দ্রের অত্যন্ত লজ্জাবোধ হইতে লাগিল। যে উন্মত্ততায় সমস্ত
পৃথিবীকে সে লক্ষ্য করে নাই, সে মত্ততা কোথায়। পথের অপরিচিত লোকদের দৃষ্টির সম্মুখেও তাহার সর্বাঙ্গ সংকুচিত হইতেছে কেন।

ভিতরে নূতন চাকরটা ঘুমাইয়া পড়িয়াছে– দরজা খোলাইতে অনেক হাঙ্গাম করিতে হইল। অপরিচিত নূতন বাসার অন্ধকারের মধ্যে প্রবেশ করিয়া মহেন্দ্রের মন দমিয়া গেল। মাতার আদরের ধন মহেন্দ্রের চিরদিন যে বিলাস-উপকরণে, যে-সকল টানাপাখা ও মূল্যবান চৌকি-সোফায় অভ্যস্ত, বাসার নূতন আয়োজনে তাহার অভাব সেই সন্ধ্যাবেলায় অত্যন্ত পরিস্ফুট হইয়া উঠিল। এই-সমস্ত আয়োজন মহেন্দ্রকে সম্পূর্ণ করিতে হইবে, বাসার সমস্ত ব্যবস্থার ভার তাহারই উপরে। মহেন্দ্র কখনো নিজের বা পরের আরামের জন্য চিন্তা করে নাই– আজ হইতে একটি নূতন গঠিত অসম্পূর্ণ সংসারের সমস্ত খুঁটিনাটি তাহাকেই বহন করিতে হইবে। সিঁড়িতে একটা কেরোসিনের ডিবা অপর্যাপ্ত ধূমোদগার করিয়া মিটমিট করিতেছিল– তাহার পরিবর্তে একটা ভালো ল্যাম্প কিনিতে হইবে। বারান্দা বাহিয়া সিঁড়িতে উঠিবার রাস্তাটা কলের জলের প্রবাহে স্যাঁতস্যাঁত করিতেছে– মিস্ত্রি ডাকাইয়া বিলাতি মাটির দ্বারা সে জায়গা মেরামত করা আবশ্যক। রাস্তার দিকের দুটো ঘর যে জুতার দোকানদারদের হাতে ছিল, তাহারা সে দুটো ঘর এখনো ছাড়ে নাই, তাহা লইয়া বাড়িওয়ালার সহিত লড়াই করিতে হইবে। এই-সমস্ত কাজ তাহার নিজে না করিলে নয়, ইহাই চকিতের মধ্যে মনে উদয় হইয়া তাহার শ্রান্তির বোঝায় আরো বোঝা চাপিল।

মহেন্দ্র সিঁড়ির কাছে কিছুক্ষণ দাঁড়াইয়া নিজেকে সামলাইয়া লইল– বিনোদিনীর প্রতি তাহার যে প্রেম ছিল, তাহাকে উত্তেজিত করিল। নিজেকে বুঝাইল যে, এতদিন সমস্ত পৃথিবীকে ভুলিয়া সে যাহাকে চাহিয়াছিল, আজ তাহাকে পাইয়াছে, আজ উভয়ের মাঝখানে কোনো বাধা নাই– আজ মহেন্দ্রের আনন্দের দিন। কিন্তু কোনো বাধা যে নাই, তাহাই সর্বাপেক্ষা বড়ো বাধা, আজ মহেন্দ্র নিজেই নিজের বাধা।

বিনোদিনী রাস্তা হইতে মহেন্দ্রকে দেখিয়া তাহার ধ্যানাসন হইতে উঠিয়া ঘরে আলো জ্বালিল, এবং একটা সেলাই কোলে লইয়া নতশিরে তাহাতে নিবিষ্ট হইল– এই সেলাই বিনোদিনীর আবরণ, ইহার অন্তরালে তাহার যেন একটা আশ্রয় আছে।

মহেন্দ্র ঘরে ঢুকিয়া কহিল, “বিনোদ, এখানে নিশ্চয় তোমার অনেক অসুবিধা ঘটিতেছে।”

বিনোদিনী সেলাই করিতে করিতে বলিল, “কিছুমাত্র না।”