চোখের বালি
সুখদুঃখসাগর হইতে জীবনতরীটি তীরে ভিড়াইয়া নিঃশব্দ সন্ধ্যায় একটি নিষ্কম্প বটবৃক্ষের তলায় বাঁধিয়া রাখিতে চায়, আর কিছুতেই কোনো প্রয়োজন নাই। গাড়ি চলিতে চলিতে এক-এক জায়গায় আম্রকুঞ্জ হইতে মুকুলের গন্ধ আসিতেই পল্লীর স্নিগ্ধশান্তি তাহাকে নিবিড়ভাবে আবিষ্ট করিয়া তুলিল। মনে মনে সে কহিল, ‘বেশ হইয়াছে, ভালোই হইয়াছে, নিজেকে লইয়া আর টানাছেঁড়া করিতে পারি না– এবারে সমস্ত ভুলিব, ঘুমাইব– পাড়াগাঁয়ের মেয়ে হইয়া ঘরের ও পল্লীর কাজেকর্মে সন্তোষের সঙ্গে, আরামের সঙ্গে জীবন কাটাইয়া দিব।’

তৃষিত বক্ষে এই শান্তির আশা বহন করিয়া বিনোদিনী আপনার কুটিরের মধ্যে প্রবেশ করিল। কিন্তু হায়, শান্তি কোথায়। কেবল শূন্যতা এবং দারিদ্র্য। চারি দিকেই সমস্ত জীর্ণ, অপরিচ্ছন্ন, অনাদৃত, মলিন। বহুদিনের রুদ্ধ স্যাঁতসেঁতে ঘরের বাষ্পে তাহার যেন নিশ্বাস বন্ধ হইয়া আসিল। ঘরে অল্পস্বল্প যে-সমস্ত আসবাবপত্র ছিল, তাহা কীটের দংশনে, ইঁদুরের উৎপাতে ও ধুলার আক্রমণে ছারখার হইয়া আসিয়াছে। সন্ধ্যার সময় বিনোদিনী ঘরে গিয়া পৌঁছিল– ঘর নিরানন্দ অন্ধকার। কোনোমতে সরষের তেলে প্রদীপ জ্বালাইতেই তাহার ধোঁয়ায় ও ক্ষীণ আলোতে ঘরের দীনতা আরো পরিস্ফুট হইল। আগে যাহা তাহাকে পীড়ন করিত না, এখন তাহা অসহ্য বোধ হইতে লাগিল– তাহার সমস্ত বিদ্রোহী অন্তঃকরণ সবলে বলিয়া উঠিল, ‘এখানে তো এক মুহূর্তও কাটিবে না।’ কুলুঙ্গিতে পূর্বেকার দুই-একটা ধুলায়-আচ্ছন্ন বই ও মাসিক পত্র পড়িয়া আছে, কিন্তু তাহা ছুঁইতে ইচ্ছা হইল না। বাহিরের বায়ুসম্পর্কশূন্য আমবাগানে ঝিল্লি ও মশার গুঞ্জনস্বর অন্ধকারে ধ্বনিত হইতে লাগিল।

বিনোদিনীর যে বৃদ্ধা অভিভাবিকা ছিলেন, তিনি ঘরে তালা লাগাইয়া মেয়েকে দেখিতে সুদূরে জামাইবাড়িতে গিয়াছেন। বিনোদিনী প্রতিবেশিনীদের বাড়িতে গেল। তাহারা তাহাকে দেখিয়া যেন চকিত হইয়া উঠিল। ও মা, বিনোদিনীর দিব্য রঙ সাফ হইয়া উঠিয়াছে, কাপড়চোপড় ফিটফাট, যেন মেমসাহেবের মতো। তাহারা পরস্পরে কী যেন ইশারায় কহিয়া বিনোদিনীর প্রতি লক্ষ করিয়া মুখ চাওয়া-চাওয়ি করিল। যেন কী একটা জনরব শোনা গিয়াছিল, তাহার সহিত লক্ষণ মিলিল।

বিনোদিনী তাহার পল্লী হইতে সর্বতোভাবে বহু দূরে গিয়া পড়িয়াছে, তাহা পদে-পদে অনুভব করিতে লাগিল। স্বগৃহে তাহার নির্বাসন। কোথাও তাহার এক মুহূর্তের আরামের স্থান নাই।

ডাকঘরের বুড়ো পেয়াদা বিনোদিনীর আবাল্যপরিচিত। পরদিন বিনোদিনী যখন পুষ্করিণীর ঘাটে স্নান করিতে উদ্যত হইয়াছে, এমন সময় চিঠির ব্যাগ লইয়া পেয়াদাকে পথ দিয়া যাইতে দেখিয়া বিনোদিনী আর আত্মসংবরণ করিতে পারিল না। গামছা ফেলিয়া তাড়াতাড়ি উঠিয়া গিয়া তাহাকে ডাকিয়া কহিল, “পাঁচুদাদা, আমার চিঠি আছে?”

বুড়া কহিল, “না।”

বিনোদিনী ব্যগ্র হইয়া কহিল, “থাকিতেও পারে। একবার দেখি।”

বলিয়া পাড়ার অল্প খান-পাঁচ-ছয় চিঠি লইয়া উলটাইয়া-পালটাইয়া দেখিল, কোনোটাই তাহার নহে। বিমর্ষমুখে যখন ঘাটে ফিরিয়া আসিল, তখন তাহার কোনো সখী সকৌতুক কটাক্ষে কহিল, “কী লো বিন্দি, চিঠির জন্যে এত ব্যস্ত কেন।”

আর-এক জন প্রগল্‌ভা কহিল, “ভালো ভালো, ডাকের চিঠি আসে এত ভাগ্য কয়জনের। আমাদের তো স্বামী, দেবর, ভাই বিদেশে কাজ করে কিন্তু ডাকের পেয়াদার দয়া হয় না।”

এইরূপে কথায় কথায় পরিহাস স্ফুটতর ও কটাক্ষ তীক্ষ্ণতর হইয়া উঠিতে লাগিল। বিনোদিনী বিহারীকে অনুনয় করিয়া আসিয়াছিল, প্রত্যহ যদি নিতান্ত না ঘটে, তবে অন্তত সপ্তাহে দুইবার তাহাকে কিছু নাহয় তো দুই ছত্রও যেন চিঠি লেখে। আজই বিহারীর চিঠি পাইবার সম্ভাবনা অত্যন্ত বিরল, কিন্তু আকাঙ্ক্ষা এত অধিক হইয়া উঠিল যে, দূর সম্ভাবনার আশাও বিনোদিনী ছাড়িতে পারিল না। তাহার মনে হইতে লাগিল, যেন কতকাল কলিকাতা ত্যাগ করিয়াছে।