প্রকল্প সম্বন্ধেপ্রকল্প রূপায়ণেরবীন্দ্র-রচনাবলীজ্ঞাতব্য বিষয়পাঠকের চোখেআমাদের লিখুনডাউনলোডঅন্যান্য রচনা-সম্ভার |
ছবিটি মহেন্দ্র ও আশার বিবাহের অনতিকাল পরের যুগলমূর্তি। ছবির পশ্চাতে মহেন্দ্র নিজের অক্ষরে ‘মহিনদা’ এবং আশা স্বহস্তে ‘আশা’ এই নামটুকু লিখিয়া দিয়াছিল। ছবির মধ্যে সেই নবপরিণয়ের মধুর দিনটি আর ঘুচিল না। মহেন্দ্র চৌকিতে বসিয়া আছে, তাহার মুখে নূতন বিবাহের একটি নবীন সরস ভাবাবেশ; পাশে আশা দাঁড়াইয়া– ছবিওয়ালা তাহাকে মাথায় ঘোমটা দিতে দেয় নাই, কিন্তু তাহার মুখ হইতে লজ্জাটুকু খসাইতে পারে নাই। আজ মহেন্দ্র তাহার পার্শ্বচরী আশাকে কাঁদাইয়া কতদূরে চলিয়া যাইতেছে, কিন্তু জড় ছবি মহেন্দ্রের মুখ হইতে নবীন প্রেমের একটি রেখাও বদল হইতে দেয় নাই, কিছু না বুঝিয়া মূঢ়ভাবে অদৃষ্টের পরিহাসকে স্থায়ী করিয়া রাখিয়াছে।
এই ছবিখানি কোলে লইয়া বিহারী বিনোদিনীকে ধিক্কারের দ্বারা সুদূরে নির্বাসিত করিতে চাহিল। কিন্তু বিনোদিনীর সেই প্রেমে-কাতর যৌবনে-কোমল বাহুদুটি বিহারীর জানু চাপিয়া রহিল। বিহারী মনে মনে কহিল, ‘এমন সুন্দর প্রেমের সংসার ছারখার করিয়া দিলি!’ কিন্তু বিনোদিনীর সেই উর্ধ্বোৎক্ষিপ্ত ব্যাকুল মুখের চুম্বন-নিবেদন তাহাকে নীরবে কহিতে লাগিল, ‘আমি তোমাকে ভালোবাসি। সমস্ত জগতের মধ্যে আমি তোমাকে বরণ করিয়াছি।’
কিন্তু এই কি জবাব হইল। এই কথাই কি একটি ভগ্ন সংসারের নিদারুণ আর্তস্বরকে ঢাকিতে পারে। পিশাচী!
পিশাচী! বিহারী এটা কি পুরা ভর্ৎসনা করিয়া বলিল, না, ইহার সঙ্গে একটুখানি আদরের সুর আসিয়াও মিশিল। যে মুহূর্তে বিহারী তাহার সমস্ত জীবনের সমস্ত প্রেমের দাবি হইতে বঞ্চিত হইয়া একেবারে নিঃস্ব ভিখারীর মতো পথে আসিয়া দাঁড়াইয়াছে, সেই মুহূর্তে বিহারী কি এমন অযাচিত অজস্র প্রেমের উপহার সমস্ত হৃদয়ের সহিত উপেক্ষা করিয়া ফেলিয়া দিতে পারে। ইহার তুলনায় বিহারী কী পাইয়াছে। এতদিন পর্যন্ত সমস্ত জীবন উৎসর্গ করিয়া সে কেবল প্রেম-ভাণ্ডারের খুদকুঁড়া ভিক্ষা করিতেছিল। প্রেমের অন্নপূর্ণা সোনার থালা ভরিয়া আজ একা তাহারই জন্য যে ভোজ পাঠাইয়াছেন, হতভাগ্য কিসের দ্বিধায় তাহা হইতে নিজেকে বঞ্চিত করিবে।
ছবি কোলে লইয়া এইরকম নানা কথা যখন সে একমনে আলোচনা করিতেছিল, এমন সময় পার্শ্বে শব্দ শুনিয়া চমকিয়া উঠিয়া দেখিল মহেন্দ্র আসিয়াছে। চকিত হইয়া দাঁড়াইয়া উঠিতেই কোল হইতে ছবিখানি নীচে কার্পেটের উপর পড়িয়া গেল– বিহারী তাহা লক্ষ্য করিল না।
মহেন্দ্র একেবারেই বলিয়া উঠিল, “বিনোদিনী কোথায়।”
বিহারী মহেন্দ্রের কাছে অগ্রসর হইয়া তাহার হাত ধরিয়া কহিল, “মহিনদা, একটু বোসো ভাই, সকল কথার আলোচনা করা যাইতেছে।”
মহেন্দ্র কহিল, “আমার বসিবার এবং আলোচনা করিবার সময় নাই। বলো, বিনোদিনী কোথায়।”
বিহারী কহিল, “তুমি যে প্রশ্নটি জিজ্ঞাসা করিতেছ, এক কথায় তাহার উত্তর দেওয়া চলে না। একটু তোমাকে স্থির হইয়া বসিতে হইবে।”
মহেন্দ্র কহিল, “উপদেশ দিবে? সে-সব উপদেশের কথা আমি শিশুকালেই পড়িয়াছি।”
বিহারী। না, উপদেশ দিবার অধিকার ও ক্ষমতা আমার নাই।
মহেন্দ্র। ভর্ৎসনা করিবে? আমি জানি আমি পাষণ্ড, আমি নরাধম এবং তুমি যাহা বলিতে চাও তাহা সবই। কিন্তু কথা এই, তুমি জান কি না, বিনোদিনী কোথায়।
বিহারী। জানি।
মহেন্দ্র। আমাকে বলিবে কি না।