চোখের বালি
মহেন্দ্র কেন স্পষ্ট করিয়া বলে না– বিচার করিয়া তাহার উপযুক্ত দণ্ড কেন না দেয়। মহেন্দ্র খোলসা কোনো কথা না বলিয়া কেবলই আশাকে যেন এড়াইয়া বেড়াইতেছে, তাই আশার বার বার মনে হইতে লাগিল, মহেন্দ্রের মনে এমন কোনো সন্দেহ আসিয়াছে, যাহা নিজেই সে অন্যায় বলিয়া জানে, যাহা সে আশার কাছে স্পষ্ট করিয়া স্বীকার করিতেও লজ্জা বোধ করিতেছে। নহিলে এমন অপরাধীর মতো তাহার চেহারা হইবে কেন। ক্রুদ্ধ বিচারকের তো এমন কুণ্ঠিত ভাব হইবার কথা নহে।

মহেন্দ্র গাড়ি হইতে চকিতের মতো সেই-যে আশার ম্লান করুণ মুখ দেখিয়া গেল, তাহা সমস্ত দিনে সে মন হইতে মুছিতে পারিল না। কালেজের লেকচারের মধ্যে, শ্রেণীবদ্ধ ছাত্রমণ্ডলীর মধ্যে, সেই বাতায়ন, আশার সেই অস্নাত রুক্ষ কেশ, সেই মলিন বস্ত্র, সেই ব্যথিত-ব্যাকুল দৃষ্টিপাত সুস্পষ্টরেখায় বারংবার অঙ্কিত হইয়া উঠিতে লাগিল।

কালেজের কাজ সারিয়া সে গোলদিঘির ধারে বেড়াইতে লাগিল। বেড়াইতে বেড়াইতে সন্ধ্যা হইয়া আসিল; আশার সঙ্গে কিরূপ ব্যবহার কর্তব্য তাহা সে কিছুতেই ভাবিয়া পাইল না– সদয় ছলনা, না অকপট নিষ্ঠুরতা, কোন্‌টা উচিত। বিনোদিনীকে পরিত্যাগ করিবে কি না, সে-তর্ক আর মনে উদয়ই হয় না। দয়া এবং প্রেম, মহেন্দ্র উভয়ের দাবি কেমন করিয়া রাখিবে।

মহেন্দ্র তখন মনকে এই বলিয়া বুঝাইল যে, আশার প্রতি এখনো তাহার যে ভালোবাসা আছে, তাহা অল্প স্ত্রীর ভাগ্যে জোটে। সেই স্নেহ সেই ভালোবাসা পাইলে আশা কেন না সন্তুষ্ট থাকিবে। বিনোদিনী এবং আশা, উভয়কেই স্থান দিবার মতো প্রশস্ত হৃদয় মহেন্দ্রের আছে। বিনোদিনীর সহিত মহেন্দ্রের যে পবিত্র প্রেমের সম্বন্ধ তাহাতে দাম্পত্যনীতির কোনো ব্যাঘাত হইবে না।

এইরূপ বুঝাইয়া মহেন্দ্র মন হইতে একটা ভার নামাইয়া ফেলিল। বিনোদিনী এবং আশা, কাহাকেও ত্যাগ না করিয়া দুইচন্দ্রসেবিত গ্রহের মতো এইভাবেই সে চিরকাল কাটাইয়া দিতে পারিবে, এই মনে করিয়া তাহার মন প্রফুল্ল হইয়া উঠিল। আজ রাত্রে সে সকাল সকাল বিছানায় প্রবেশ করিয়া আদরে যত্নে স্নিগ্ধ আলাপে আশার মন হইতে সমস্ত বেদনা দূর করিয়া দিবে, ইহা নিশ্চয় করিয়া দ্রুতপদে বাড়ি চলিয়া আসিল।

আহারের সময় আশা উপস্থিত ছিল না, কিন্তু সে এক সময় শুইতে আসিবে তো, এই মনে করিয়া মহেন্দ্র বিছানার মধ্যে প্রবেশ করিল। কিন্তু নিস্তব্ধ ঘরে সেই শূন্য শয্যার মধ্যে কোন্‌ স্মৃতি মহেন্দ্রের হৃদয়কে আবিষ্ট করিয়া তুলিল। আশার সহিত নবপরিণয়ের নিত্যনূতন লীলাখেলা? না। সূর্যালোকের কাছে জ্যোৎস্না যেমন মিলাইয়া যায়, সে-সকল স্মৃতি তেমনি ক্ষীণ হইয়া আসিয়াছে– একটি তীব্র-উজ্জ্বল তরুণীমূর্তি, সরলা বালিকার সলজ্জ স্নিগ্ধচ্ছবিকে কোথায় আবৃত আচ্ছন্ন করিয়া দীপ্যমান হইয়া উঠিয়াছে। বিনোদিনীর সঙ্গে বিষবৃক্ষ লইয়া সেই কাড়াকাড়ি মনে পড়িতে লাগিল; সন্ধ্যার পর বিনোদিনী কপালকুণ্ডলা পড়িয়া শুনাইতে শুনাইতে ক্রমে রাত্রি হইয়া আসিত, বাড়ির লোক ঘুমাইয়া পড়িত, রাত্রে নিভৃত কক্ষের সেই স্তব্ধ নির্জনতায় বিনোদিনীর কণ্ঠস্বর যেন আবেশে মৃদুতর ও রুদ্ধপ্রায় হইয়া আসিত, হঠাৎ সে আত্মসংবরণ করিয়া বই ফেলিয়া উঠিয়া পড়িত, মহেন্দ্র বলিত, ‘তোমাকে সিঁড়ির নীচে পর্যন্ত পৌঁছাইয়া দিয়া আসি।’ সেই-সকল কথা বারংবার মনে পড়িয়া তাহার সর্বাঙ্গে পুলকসঞ্চার করিতে লাগিল। রাত্রি বাড়িয়া চলিল– মহেন্দ্রের মনে মনে ঈষৎ আশঙ্কা হইতে লাগিল, এখনই আশা আসিয়া পড়িবে– কিন্তু আশা আসিল না। মহেন্দ্র ভাবিল, ‘আমি তো কর্তব্যের জন্য প্রস্তুত ছিলাম, কিন্তু আশা যদি অন্যায় রাগ করিয়া না আসে তো আমি কী করিব।’ এই বলিয়া নিশীথরাত্রে বিনোদিনীর ধ্যানকে ঘনীভূত করিয়া তুলিল।

ঘড়িতে যখন একটা বাজিল, তখন মহেন্দ্র আর থাকিতে পারিল না, মশারি খুলিয়া বাহির হইয়া পড়িল। ছাদে আসিয়া দেখিল, গ্রীষ্মের জ্যোৎস্নারাত্রি বড়ো রমণীয় হইয়াছে। কলিকাতার প্রকাণ্ড নিঃশব্দতা এবং সুপ্তি যেন স্তব্ধ সমুদ্রের জলরাশির ন্যায় স্পর্শগম্য বলিয়া বোধ হইতেছে– অসংখ্য হর্ম্যশ্রেণীর উপর দিয়া মহানগরীর নিদ্রাকে নিবিড়তর করিয়া বাতাস মৃদুগমনে পদচারণ করিয়া আসিতেছে।