চোখের বালি
অবস্থায় তেমনিভাবে আছে; অন্যদিন মহেন্দ্র এ-সমস্ত লক্ষ্যই করে না– আজ তাহা চোখে পড়িল। কহিল, “বিনোদিনী আসিয়া না ফেলিয়া দিলে, ও আর ফেলাই হইবে না।” বলিয়া ফুলসুদ্ধ ফুলদানি বাহিরে ছুঁড়িয়া ফেলিল, তাহা ঠংঠং শব্দে সিঁড়ি দিয়া গড়াইয়া চলিল। ‘কেন আশা আমার মনের মতো হইতেছে না, কেন সে আমার মনের মতো কাজ করিতেছে না, কেন তাহার স্বভাবগত শৈথিল্য ও দুর্বলতায় সে আমাকে দাম্পত্যের পথে দৃঢ়ভাবে ধরিয়া রাখিতেছে না, সর্বদা আমাকে বিক্ষিপ্ত করিয়া দিতেছে।’– এই কথা মহেন্দ্র মনে মনে আন্দোলন করিতে করিতে হঠাৎ দেখিল, আশার মুখ পাংশুবর্ণ হইয়া গেছে, সে খাটের থাম ধরিয়া আছে, তাহার ঠোঁট-দুটি কাঁপিতেছে– কাঁপিতে কাঁপিতে সে হঠাৎ বেগে পাশের ঘর দিয়া চলিয়া গেল।

মহেন্দ্র তখন ধীরে ধীরে গিয়া ফুলদানিটা কুড়াইয়া আনিয়া রাখিল। ঘরের কোণে তাহার পড়িবার টেবিল ছিল– চৌকিতে বসিয়া সেই টেবিলটার উপর হাতের মধ্যে মাথা রাখিয়া অনেকক্ষণ পড়িয়া রহিল।

সন্ধ্যার পর ঘরে আলো দিয়া গেল, কিন্তু আশা আসিল না। মহেন্দ্র দ্রুতপদে ছাদের উপর পায়চারি করিয়া বেড়াইতে লাগিল। রাত্রি নটা বাজিল, মহেন্দ্রদের লোকবিরল গৃহ রাত-দুপুরের মতো নিস্তব্ধ হইয়া গেল– তবু আশা আসিল না। মহেন্দ্র তাহাকে ডাকিয়া পাঠাইল। আশা সংকুচিত পদে আসিয়া ছাদের প্রবেশদ্বারের কাছে দাঁড়াইয়া রহিল। মহেন্দ্র কাছে আসিয়া তাহাকে বুকে টানিয়া লইল– মুহূর্তের মধ্যে স্বামীর বুকের উপর আশার কান্না ফাটিয়া পড়িল– সে আর থামিতে পারে না, তাহার চোখের জল আর ফুরায় না, কান্নার শব্দ গলা ছাড়িয়া বাহির হইতে চায়, সে আর চাপা থাকে না। মহেন্দ্র তাহাকে বক্ষে বদ্ধ করিয়া কেশচুম্বন করিল– নিঃশব্দ আকাশে তারাগুলি নিস্তব্ধ হইয়া চাহিয়া রহিল।

রাত্রে বিছানায় বসিয়া মহেন্দ্র কহিল, “কালেজে আমাদের নাইট-ডিউটি অধিক পড়িয়াছে, অতএব এখন কিছুকাল আমাকে কালেজের কাছেই বাসা করিয়া থাকিতে হইবে।”

আশা ভাবিল, ‘এখনো কি রাগ আছে। আমার উপর বিরক্ত হইয়া চলিয়া যাইতেছেন? নিজের নির্গুণতায় আমি স্বামীকে ঘর হইতে বিদায় করিয়া দিলাম? আমার তো মরা ভালো ছিল।’

কিন্তু মহেন্দ্রের ব্যবহারে রাগের লক্ষণ কিছুই দেখা গেল না। সে অনেকক্ষণ কিছু না বলিয়া আশার মুখ বুকের উপর রাখিল এবং বারংবার অঙ্গুলি দিয়া তাহার চুল চিরিতে চিরিতে তাহার খোঁপা শিথিল করিয়া দিল। পূর্বে আদরের দিনে মহেন্দ্র এমন করিয়া আশার বাঁধা চুল খুলিয়া দিত– আশা তাহাতে আপত্তি করিত। আজ আর সে তাহাতে কোনো আপত্তি না করিয়া পুলকে বিহ্বল হইয়া চুপ করিয়া রহিল। হঠাৎ এক সময় তাহার ললাটের উপর অশ্রুবিন্দু পড়িল, এবং মহেন্দ্র তাহার মুখ তুলিয়া ধরিয়া স্নেহরুদ্ধ স্বরে ডাকিল, “চুনি।” আশা কথায় তাহার কোনো উত্তর না দিয়া দুই কোমল হস্তে মহেন্দ্রকে চাপিয়া ধরিল। মহেন্দ্র কহিল, “অপরাধ করিয়াছি, আমাকে মাপ করো।”

আশা তাহার কুসুম-সুকুমার করপল্লব মহেন্দ্রের মুখের উপর চাপা দিয়া কহিল, “না, না, অমন কথা বলিয়ো না। তুমি কোনো অপরাধ কর নাই। সকল দোষ আমার। আমাকে তোমার দাসীর মতো শাসন করো। আমাকে তোমার চরণাশ্রয়ের যোগ্য করিয়া লও।”

বিদায়ের প্রভাতে শয্যাত্যাগ করিবার সময় মহেন্দ্র কহিল, “চুনি, আমার রত্ন, তোমাকে আমার হৃদয়ে সকলের উপরে ধারণ করিয়া রাখিব, সেখানে কেহ তোমাকে ছাড়াইয়া যাইতে পারিবে না।”

তখন আশা দৃঢ়চিত্তে সর্বপ্রকার ত্যাগস্বীকারে প্রস্তুত হইয়া স্বামীর নিকট নিজের একটিমাত্র ক্ষুদ্র দাবি দাখিল করিল। কহিল, “তুমি আমাকে রোজ একখানি করিয়া চিঠি দিবে?”