চোখের বালি
সেখানে ভিক্ষা করা কেন। আদর যে কাড়িয়া লইতে পারেন। কী বলেন মহেন্দ্রবাবু।”

মহেন্দ্রবাবুর তখন বাক্যস্ফূর্তি হইতেছিল না।

বিনোদিনী। বিহারীবাবু, লজ্জা করিয়া খাইতেছেন না, না রাগ করিয়া? আর-কাহাকেও ডাকিয়া আনিতে হইবে?

বিহারী। কোনো দরকার নাই। যাহা পাইলাম তাহাই প্রচুর।

বিনোদিনী। ঠাট্টা? আপনার সঙ্গে পারিবার জো নাই। মিষ্টান্ন দিলেও মুখ বন্ধ হয় না।

রাত্রে আশা মহেন্দ্রের নিকটে বিহারী সম্বন্ধে রাগ প্রকাশ করিল– মহেন্দ্র অন্য দিনের মতো হাসিয়া উড়াইয়া দিল না– সম্পূর্ণ যোগ দিল।

প্রাতঃকালে উঠিয়াই মহেন্দ্র বিহারীর বাড়ি গেল। কহিল, “বিহারী, বিনোদিনী হাজার হউক ঠিক বাড়ির মেয়ে নয়– তুমি সামনে আসিলে সে যেন কিছু বিরক্ত হয়।”

বিহারী কহিল, “তাই নাকি। তবে কাজটা ভালো হয় না। তিনি যদি আপত্তি করেন, তাঁর সামনে নাই
গেলাম।”

মহেন্দ্র নিশ্চিন্ত হইল। এত সহজে এই অপ্রিয় কার্য শেষ হইবে, তাহা সে মনে করে নাই। বিহারীকে মহেন্দ্র ভয় করে।

সেইদিনই বিহারী মহেন্দ্রের অন্তঃপুরে গিয়া কহিল, “বিনোদ-বৌঠান, মাপ করিতে হইবে।”

বিনোদিনী। কেন, বিহারীবাবু।

বিহারী। মহেন্দ্রের কাছে শুনিলাম, আমি অন্তঃপুরে আপনার সামনে বাহির হই বলিয়া আপনি বিরক্ত হইয়াছেন। তাই ক্ষমা চাহিয়া বিদায় হইব।

বিনোদিনী। সে কি হয়, বিহারীবাবু। আমি আজ আছি কাল নাই, আপনি আমার জন্যে কেন যাইবেন। এত গোল হইবে জানিলে আমি এখানে আসিতাম না।

এই বলিয়া বিনোদিনী মুখ ম্লান করিয়া যেন অশ্রুসংবরণ করিতে দ্রুতপদে চলিয়া গেল।

বিহারী ক্ষণকালের জন্যে মনে করিল, ‘মিথ্যা সন্দেহ করিয়া আমি বিনোদিনীকে অন্যায় আঘাত করিয়াছি।’

সেদিন সন্ধ্যাবেলায় রাজলক্ষ্মী বিপন্নভাবে আসিয়া কহিলেন, “মহিন, বিপিনের বউ যে বাড়ি যাইবে বলিয়া ধরিয়া বসিয়াছে।”

মহেন্দ্র কহিল, “কেন মা, এখানে তাঁর কি অসুবিধা হইতেছে।”

রাজলক্ষ্মী। অসুবিধা না। বউ বলিতেছে, তাহার মতো সমর্থবয়সের বিধবা মেয়ে পরের বাড়ি বেশি দিন থাকিলে লোকে নিন্দা করিবে।

মহেন্দ্র ক্ষুদ্ধভাবে কহিল, “এ বুঝি পরের বাড়ি হইল?”

বিহারী বসিয়া ছিল– মহেন্দ্র তাহার প্রতি ভর্ৎসনাদৃষ্টি নিক্ষেপ করিল।

অনুতপ্ত বিহারী ভাবিল, ‘কাল আমার কথাবার্তায় একটু যেন নিন্দার আভাস ছিল; বিনোদিনী বোধ হয় তাহাতেই বেদনা পাইয়াছে।’

স্বামী স্ত্রী উভয়ে মিলিয়া বিনোদিনীর উপর অভিমান করিয়া বসিল।

ইনি বলিলেন, “আমাদের পর মনে কর, ভাই!” উনি বলিলেন, “এতদিন পরে আমরা পর হইলাম!”

বিনোদিনী কহিল, “আমাকে কি তোমরা চিরকাল ধরিয়া রাখিবে, ভাই।”

মহেন্দ্র কহিল, “এত কি আমাদের স্পর্ধা।”