একটা আষাঢ়ে গল্প
দেয়, “ কিছু ভুল নাই, আজ হইতে আমিই গোলাম। ”

নবপ্রস্ফুটিত রমণীহৃদয় হইতে এ কী অভূতপূর্ব শোভা, এ কী অভাবনীয় লাবণ্য বিস্ফুরিত হইতে লাগিল। তাহার গতিতে এ কী সুমধুর চাঞ্চল্য, তাহার দৃষ্টিপাতে এ কী হৃদয়ের হিল্লোল, তাহার সমস্ত অস্তিত্ব হইতে এ কী একটি সুগন্ধি আরতি-উচ্ছ্বাস উচ্ছ্বসিত হইয়া উঠিতেছে।

এই নব অপরাধিনীর ভ্রমসংশোধনে সাতিশয় মনোযোগ করিতে গিয়া আজকাল সকলেরই ভ্রম হইতে লাগিল। টেক্কা আপনার চিরন্তন মর্যাদারক্ষার কথা বিস্মৃত হইল, সাহেবে গোলামে আর প্রভেদ থাকে না, দহলা-নহলাগুলা পর্যন্ত কেমন হইয়া গেল।

এই পুরাতন দ্বীপে বসন্তের কোকিল অনেকবার ডাকিয়াছে, কিন্তু সেইবার যেমন ডাকিল এমন আর-কখনো ডাকে নাই। সমুদ্র চিরদিন একতান কলধ্বনিতে গান করিয়া আসিতেছে; কিন্তু এতদিন সে সনাতন বিধানের অলঙ্ঘ্য মহিমা একসুরে ঘোষণা করিয়া আসিয়াছে — আজ সহসা দক্ষিণবায়ুচঞ্চল বিশ্বব্যাপী দুরন্ত যৌবনতরঙ্গরাশির মতো আলোতে ছায়াতে ভঙ্গীতে ভাষাতে আপনার অগাধ আকুলতা ব্যক্ত করিতে চেষ্টা করিতে লাগিল।


এই কি সেই টেক্কা, সেই সাহেব, সেই গোলাম। কোথায় গেল সেই পরিতুষ্ট পরিপুষ্ট সুগোল মুখচ্ছবি। কেহ বা আকাশের দিকে চায়, কেহ বা সমুদ্রের ধারে বসিয়া থাকে, কাহারো বা রাত্রে নিদ্রা হয় না, কাহারো বা আহারে মন নাই।

মুখে কাহারো ঈর্ষা, কাহারো অনুরাগ, কাহারো ব্যাকুলতা, কাহারো সংশয়। কোথাও হাসি, কোথাও রোদন, কোথাও সংগীত। সকলেরই নিজের নিজের প্রতি এবং অন্যের প্রতি দৃষ্টি পড়িয়াছে। সকলেই আপনার সহিত অন্যের তুলনা করিতেছে।

টেক্কা ভাবিতেছে, ‘ সাহেব ছোকরাটাকে দেখিতে নেহাত মন্দ না হউক কিন্তু উহার শ্রী নাই — আমার চাল-চলনের মধ্যে এমন একটা মাহাত্ম্য আছে যে, কোনো কোনো ব্যক্তিবিশেষের দৃষ্টি আমার দিকে আকৃষ্ট না হইয়া থাকিতে পারে না। '

সাহেব ভাবিতেছে, ‘ টেক্কা সর্বদা ভারি টক্‌টক্‌ করিয়া ঘাড় বাঁকাইয়া বেড়াইতেছে; মনে করিতেছে, উহাকে দেখিয়া বিবিগুলা বুক ফাটিয়া মারা গেল। ' – বলিয়া ঈষৎ বক্র হাসিয়া দর্পণে মুখ দেখিতেছে।

দেশে যতগুলি বিবি ছিলেন সকলেই প্রাণপণে সাজসজ্জা করেন আর পরস্পরকে লক্ষ্য করিয়া বলেন, ‘ আ মরিয়া যাই। গর্বিণীর এত সাজের ধুম কিসের জন্য গো, বাপু। উহার রকম-সকম দেখিয়া লজ্জা করে! ' বলিয়া দ্বিগুণ প্রযত্নে হাবভাব বিস্তার করিতে থাকেন।

আবার কোথাও দুই সখায়, কোথাও দুই সখীতে গলা ধরিয়া নিভৃতে বসিয়া গোপন কথাবার্তা হইতে থাকে। কখনো হাসে, কখনো কাঁদে, কখনো রাগ করে, কখনো মান-অভিমান চলে, কখনো সাধাসাধি হয়।

যুবকগুলা পথের ধারে বনের ছায়ায় তরুমূলে পৃষ্ঠ রাখিয়া, শুষ্কপত্ররাশির উপর পা ছড়াইয়া অলসভাবে বসিয়া থাকে। বালা সুনীল বসন পরিয়া সেই ছায়াপথ দিয়া আপনমনে চলিতে চলিতে সেইখানে আসিয়া মুখ নত করিয়া চোখ ফিরাইয়া লয় — যেন কাহাকেও দেখিতে পায় নাই, যেন কাহাকেও দেখা দিতে আসে নাই, এমনি ভাব করিয়া চলিয়া যায়।

তাই দেখিয়া কোনো কোনো খেপা যুবক দুঃসাহসে ভর করিয়া তাড়াতাড়ি কাছে অগ্রসর হয়, কিন্তু মনের মতো একটাও কথা জোগায় না, অপ্রতিভ হইয়া দাঁড়াইয়া পড়ে, অনুকূল অবসর চলিয়া যায় এবং রমণীও অতীত মুহূর্তের মতো ক্রমে ক্রমে দূরে বিলীন হইয়া যায়।