ফেল
বাড়ি হইতে বিচিত্র থালার উপর বিবিধ উপঢৌকন লইয়া দাসীচাকরের দল সার বাঁধিয়া চলিয়াছে।

নলিন কহিল, “দেখে এসো তো হে, ব্যাপারখানা কী।”

খবর আসিল, নন্দর ভাবী বধূর জন্য পানপত্র যাইতেছে।

নলিন তৎক্ষণাৎ গুড়গুড়ি টানা বন্ধ করিয়া সচকিত হইয়া উঠিয়া বসিল; বলিল, “খবর নিতে হচ্ছে তো।”

তৎক্ষণাৎ গাড়ি ভাড়া করিয়া ছড়্‌ ছড়্‌ শব্দে দূত ছুটিল। বিপিন হাজরা ফিরিয়া আসিয়া কহিল, “কলকাতার মেয়ে, কিন্তু খাসা মেয়ে।”

নলিনের বুক দমিয়া গেল, কহিল, “বল কী হে।”

হাজরা কেবলমাত্র কহিল, “খাসা মেয়ে।”

নলিন বলিল, “এ তো দেখতে হচ্ছে।”

পারিষদ বলিল, “সে আর শক্তটা কী!” বলিয়া তর্জনী ও অঙ্গুষ্ঠে একটা কাল্পনিক টাকা বাজাইয়া দিল।

সুযোগ করিয়া নলিন মেয়ে দেখিল। যতই মনে হইল, এ মেয়ে নন্দর জন্য একেবারে স্থির হইয়া গেছে, ততই বোধ হইতে লাগিল, মেয়েটি রাওলপিণ্ডজার চেয়ে ভালো দেখিতে। দ্বিধাপীড়িত হইয়া নলিন পারিষদকে জিজ্ঞাসা করিল, “কেমন ঠেকছে হে।”

হাজরা কহিল, “আজ্ঞে, আমাদের চোখে তো ভালোই ঠেকছে।”

নলিন কহিল, “সে ভালো কি এ ভালো।”

হাজরা বলিল, “এ ই ভালো।”

তখন নলিনের বোধ হইল, ইহার চোখের পল্লব তাহার চেয়েও আরো একটু যেন ঘন;তাহার রঙটা ইহার চেয়ে একটু যেন বেশি ফ্যাকাশে, ইহার গৌরবর্ণে একটু যেন হলদে আভায় সোনা মিশাইয়াছে। ইহাকে তো হাতছাড়া করা যায় না।

নলিন বিমর্ষভাবে চিত হইয়া গুড়গুড়ি টানিতে টানিতে কহিল, “ওহে হাজরা, কী করা যায় বলো তো।”

হাজরা বলিল, “মহারাজ, শক্তটা কী।” বলিয়া পুনশ্চ অঙ্গুষ্ঠে তর্জনীতে কাল্পনিক টাকা বাজাইয়া দিল।

টাকাটা যখন সত্যই সশব্দে বাজিয়া উঠিল তখন যথোচিত ফল হইতে বিলম্ব হইল না। কন্যার পিতা একটা অকারণ ছুতা করিয়া বরের পিতার সহিত তুমুল ঝগড়া বাধাইলেন। বরের পিতা বলিলেন, “তোমার কন্যার সহিত আমার পুত্রের যদি বিবাহ দিই তবে –” ইত্যাদি ইত্যাদি।

কন্যার পিতা আরো একগুণ অধিক করিয়া বলিলেন, “তোমার পুত্রের সহিত আমার কন্যার যদি বিবাহ দিই তবে” ইত্যাদি ইত্যাদি।

অতঃপর আর বিলম্ব মাত্র না করিয়া নলিন নন্দকে ফাঁকি দিয়া শুভলগ্নে শুভবিবাহ সত্বর সম্পন্ন করিয়া ফেলিল। এবং হাসিতে হাসিতে হাজরাকে বলিল, “বি. এ. পাস করা তো একেই বলে। কী বলো হে হাজরা। এবারে আমাদের ও বাড়ির বড়োবাবু ফেল।”

অনতিকাল পরেই ননীগোপালের বাড়িতে একদিন ঢাক ঢোল সানাই বাজিয়া উঠিল। নন্দর গায়ে-হলুদ।

নলিন কহিল, “ওহে হাজরা, খবর লও তো পাত্রীটি কে।”

হাজরা আসিয়া খবর দিল, পাত্রীটি সেই রাওলপিণ্ডির মেয়ে।

রাওলপিণ্ডির মেয়ে! হাঃ হাঃ হাঃ। নলিন অত্যন্ত হাসিতে লাগিল। ও বাড়ির বড়োবাবু আর কন্যা পাইলেন না, আমাদেরই পরিত্যক্ত পাত্রীটিকে বিবাহ করিতেছেন। হাজরাও বিস্তর হাসিল।

কিন্তু, উত্তরোত্তর নলিনের হাসির আর জোর রহিল না। তাহার হাসির মধ্যে কীট প্রবেশ করিল। একটি ক্ষুদ্র সংশয় তীক্ষ্ম স্বরে