প্রকল্প সম্বন্ধেপ্রকল্প রূপায়ণেরবীন্দ্র-রচনাবলীজ্ঞাতব্য বিষয়পাঠকের চোখেআমাদের লিখুনডাউনলোডঅন্যান্য রচনা-সম্ভার |
রাজা কহিলেন “মা, এ রক্তস্রোত আমি নিবারণ করিব।”
বালিকা বলিল, “আয় ভাই তাতা, আমরা দুজনে এ রক্ত মুছে ফেলি।”
রাজা কহিলেন, “আয় মা, আমিও মুছি।”
সন্ধ্যার কিছু পরেই হাসি একবার চোখ খুলিয়াছিল। একবার চারি দিকে চাহিয়া কাহাকে যেন খুঁজিল। তখন তাতা অন্য ঘরে কাঁদিয়া কাঁদিয়া ঘুমাইয়া পড়িয়াছে। কাহাকে যেন না দেখিতে পাইয়া হাসি চোখ বুজিল। চক্ষু আর খুলিল না। রাত্রি দ্বিপ্রহরের সময় রাজার কোলে হাসির মৃত্যু হইল।
হাসিকে যখন চিরদিনের জন্য কুটির হইতে লইয়া গেল, তখন তাতা অজ্ঞান হইয়া ঘুমাইতেছিল। সে যদি জানিতে পাইত, তবে সেও বুঝি দিদির সঙ্গে সঙ্গে ছোটো ছায়াটার মতো চলিয়া যাইত।
রাজার সভা বসিয়াছে। ভুবনেশ্বরী-দেবী-মন্দিরের পুরোহিত কার্যবশত রাজদর্শনে আসিয়াছেন।
পুরোহিতের নাম রঘুপতি। এ দেশে পুরোহিতকে চোন্তাই বলিয়া থাকে। ভুবনেশ্বরী দেবীর পূজার চৌদ্দ দিন পরে গভীর রাত্রে চতুর্দশ দেবতার এক পূজা হয়। এই পূজার সময় এক দিন দুই রাত্রি কেহ ঘরের বাহির হইতে পারে না, রাজাও না। রাজা যদি বাহির হন, তবে চোন্তাইয়ের নিকটে তাঁহাকে অর্থদণ্ড দিতে হয়। প্রবাদ আছে, এই পূজার রাত্রে মন্দিরে নরবলি হয়। এই পূজা উপলক্ষে সর্বপ্রথমে যে-সকল পশুবলি হয়, তাহা রাজবাড়ির দান বলিয়া গৃহীত হয়। এই বলির পশু গ্রহণ করিবার জন্য চোন্তাই রাজসমীপে আসিয়াছেন। পূজার আর বারো দিন বাকি আছে।
রাজা বলিলেন, “এ বৎসর হইতে মন্দিরে জীববলি আর হইবে না।”
সভাসুদ্ধ লোক অবাক হইয়া গেল। রাজভ্রাতা নক্ষত্ররায়ের মাথার চুল পর্যন্ত দাঁড়াইয়া উঠিল।
চোন্তাই রঘুপতি বলিলেন, “আমি এ কি স্বপ্ন দেখিতেছি!”
রাজা বলিলেন, “না ঠাকুর, এতদিন আমরা স্বপ্ন দেখিতেছিলাম, আজ আমাদের চেতনা হইয়াছে। একটি বালিকার মূর্তি ধরিয়া মা আমাকে দেখা দিয়াছিলেন। তিনি বলিয়া গিয়াছেন, করুণাময়ী জননী হইয়া মা তাঁহার জীবের রক্ত আর দেখিতে পারেন না।”
রঘুপতি কহিলেন, “মা তবে এতদিন ধরিয়া জীবের রক্ত পান করিয়া আসিতেছেন কী করিয়া?”
রাজা কহিলেন, “না, পান করেন নাই। তোমরা যখন রক্তপাত করিতে তখন তিনি মুখ ফিরাইয়া থাকিতেন।”
রঘুপতি বলিলেন, “মহারাজ, রাজকার্য আপনি ভালো বুঝেন সন্দেহ নাই, কিন্তু পূজা সম্বন্ধে আপনি কিছুই জানেন না। দেবীর যদি কিছুতে অসন্তোষ হইত, আমিই আগে জানিতে পারিতাম।”
নক্ষত্ররায় অত্যন্ত বুদ্ধিমানের মতো ঘাড় নাড়িয়া কহিলেন, “হাঁ, এ ঠিক কথা। দেবীর যদি কিছুতে অসন্তোষ হইত ঠাকুরমহাশয়ই আগে জানিতে পাইতেন।”
রাজা বলিলেন, “হৃদয় যার কঠিন হইয়া গিয়াছে, দেবীর কথা সে শুনিতে পায় না।”
নক্ষত্ররায় পুরোহিতের মুখের দিকে চাহিলেন– ভাবটা এই যে, এ কথার একটা উত্তর দেওয়া আবশ্যক। রঘুপতি আগুন হইয়া উঠিয়া বলিলেন, “মহারাজ, আপনি পাষণ্ড নাস্তিকের মতো কথা কহিতেছেন।”
নক্ষত্ররায় মৃদু প্রতিধ্বনির মতো বলিলেন, “হাঁ, নাস্তিকের মতো কথা কহিতেছেন।”