প্রকল্প সম্বন্ধেপ্রকল্প রূপায়ণেরবীন্দ্র-রচনাবলীজ্ঞাতব্য বিষয়পাঠকের চোখেআমাদের লিখুনডাউনলোডঅন্যান্য রচনা-সম্ভার |
ইতিমধ্যে আমার এক পিসশাশুড়ি দেশ হইতে তাঁহার ভ্রাতুষ্পুত্রের সংবাদ লইতে আসিলেন। আমরা উভয়ে তাঁহাকে প্রণাম করিয়া উঠিতেই তিনি প্রথম কথাতেই বলিলেন, “বলি বউমা, তুমি তো কপালক্রমে দুইটি চক্ষু খোয়াইয়া বসিয়াছ, এখন আমাদের অবিনাশ অন্ধ স্ত্রীকে লইয়া ঘরকন্না চালাইবে কী করিয়া। উহার আর-একটা বিয়ে-থাওয়া দিয়া দাও! ” স্বামী যদি ঠাট্টা করিয়া বলিতেন ‘তা বেশ তো পিসিমা, তোমরা দেখিয়া-শুনিয়া একটা ঘটকালি করিয়া দাও-না’ তাহা হইলে সমস্ত পরিষ্কার হইয়া যাইত। কিন্তু তিনি কুণ্ঠিত হইয়া কহিলেন, “আঃ পিসিমা, কী বলিতেছ।” পিসিমা উত্তর করিলেন, “কেন, অন্যায় কী বলিতেছি। আচ্ছা বউমা, তুমিই বলো তো বাছা।” আমি হাসিয়া কহিলাম, “পিসিমা, ভালো লোকের কাছে পরামর্শ চাহিতেছ। যাহার গাঁঠ কাটিতে হইবে তাহার কি কেহ সম্মতি নেয়।” পিসিমা উত্তর করিলেন, “হাঁ, সে কথা ঠিক বটে। তা, তোতে আমাতে গোপনে পরামর্শ করিব, কী বলিস অবিনাশ। তাও বলি বউমা, কুলীনের মেয়ের সতিন যত বেশি হয়, তাহার স্বামিগৌরব ততই বাড়ে। আমাদের ছেলে ডাক্তারি না করিয়া যদি বিবাহ করিত, তবে উহার রোজগারের ভাবনা কী ছিল। রোগী তো ডাক্তারের হাতে পড়িলেই মরে, মরিলে তো আর ভিজিট দেয় না, কিন্তু বিধাতার শাপে কুলীনের স্ত্রীর মরণ নাই এবং সে যতদিন বাঁচে ততদিনই স্বামীর লাভ।”
দুইদিন বাদে আমার স্বামী আমার সম্মুখে পিসিমাকে জিজ্ঞাসা করিলেন, “পিসিমা, আত্মীয়ের মতো করিয়া বউয়ের সাহায্য করিতে পারে, এমন একটি ভদ্রঘরের স্ত্রীলোক দেখিয়া দিতে পার? উনি চোখে দেখিতে পান না, সর্বদা ওঁর একটি সঙ্গিনী কেহ থাকিলে আমি নিশ্চিন্ত থাকিতে পারি।” যখন নূতন অন্ধ হইয়াছিলাম তখন এ কথা বলিলে খাটিত, কিন্তু এখন চোখের অভাবে আমার কিংবা ঘরকন্নার বিশেষ কী অসুবিধা হয় জানি না; কিন্তু প্রতিবাদমাত্র না করিয়া চূপ করিয়া রহিলাম। পিসিমা কহিলেন, “অভাব কী। আমারই তো ভাসুরের এক মেয়ে আছে, যেমন সুন্দরী তেমনি লক্ষ্মী। মেয়েটির বয়স হইল, কেবল উপযুক্ত বরের প্রত্যাশায় অপেক্ষা করিয়া আছে; তোমার মতো কুলীন পাইলে এখনি বিবাহ দিয়া দেয়।” স্বামী চকিত হইয়া কহিলেন, “বিবাহের কথা কে বলিতেছে।” পিসিমা কহিলেন, “ওমা, বিবাহ না করিলে ভদ্রঘরের মেয়ে কি তোমার ঘরে অমনি আসিয়া পড়িয়া থাকিবে।” কথাটা সংগত বটে এবং স্বামী তাহার কোনো সদুত্তর দিতে পারিলেন না।
আমার রুদ্ধ চক্ষুর অনন্ত অন্ধকারের মধ্যে আমি একলা দাঁড়াইয়া ঊর্ধ্বমুখে ডাকিতে লাগিলাম, “ভগবান আমার স্বামীকে রক্ষা করো।”
তাহার দিনকয়েক পরে একদিন সকালবেলায় আমার পূজা-আহ্নিক সারিয়া বাহিরে আসিতেই পিসিমা কহিলেন, “বউমা, যে ভাসুরঝির কথা বলিয়াছিলাম সেই আমাদের হেমাঙ্গিনী আজ দেশ হইতে আসিয়াছে। হিমু, ইনি তোমার দিদি, ইঁহাকে প্রণাম করো।”
এমন সময় আমার স্বামী হঠাৎ আসিয়া যেন অপরিচিত স্ত্রীলোককে দেখিয়া ফিরিয়া যাইতে উদ্যত হইলেন। পিসিমা কহিলেন, “কোথা যাস, অবিনাশ।” স্বামী জিজ্ঞাসা করিলেন, “ইনি কে।” পিসিমা কহিলেন, “এই মেয়েটিই আমার সেই ভাসুরঝি হেমাঙ্গিনী।” ইহাকে কখন আনা হইল, কে আনিল, কী বৃত্তান্ত, লইয়া আমার স্বামী বারংবার অনেক অনাবশ্যক বিস্ময় প্রকাশ করিতে লাগিলেন।