দর্পহরণ
জগদিন্দ্র ' লিখিতে দীর্ঘ ঈ বসাইয়াছে। ” শুনিয়া বাবার বউমা নীরবে একটুখানি স্মিতহাস্য করিলেন। আমিও কথাটাকে ঠাট্টা বলিয়া হাসিলাম, কিন্তু এরকম ঠাট্টা ভালো নয়।

স্ত্রীর দম্ভের পরিচয় পাইতে আমার দেরি হইল না। পাড়ার ছেলেদের এক ক্লাব আছে ; সেখানে একদিন তাহারা এক বিখ্যাত বাংলা-লেখককে বক্তৃতা দিতে রাজি করিয়াছিল। অপর একটি বিখ্যাত লোককে সভাপতিও ঠিক করা হয় ; তিনি বক্তৃতার পূর্বরাত্রে অস্বাস্থ্য জানাইয়া ছুটি লইলেন। ছেলেরা উপায়ান্তর না দেখিয়া আমাকে আসিয়া ধরিল। আমার প্রতি ছেলেদের এই অহৈতুকী শ্রদ্ধা দেখিয়া আমি কিছু প্রফুল্ল হইয়া উঠিলাম। বলিলাম, “ তা বেশ তো, বিষয়টা কী বলো তো। ”

তাহারা কহিল, “ প্রাচীন ও আধুনিক বঙ্গসাহিত্য। ”

আমি কহিলাম, “ বেশ হইবে, দুটোই আমি ঠিক সমান জানি। ”

পরদিন সভায় যাইবার পূর্বে জলখাবার এবং কাপড়চোপড়ের জন্য স্ত্রীকে কিছু তাড়া দিতে লাগিলাম। নির্ঝরিণী কহিল, “ কেন গো, এত ব্যস্ত কেন — আবার কি পাত্রী দেখিতে যাইতেছ। ”

আমি কহিলাম, “ একবার দেখিয়াই নাকে-কানে খত দিয়াছি ; আর নয়। ”

“ তবে এত সাজসজ্জার তাড়া যে। ”

স্ত্রীকে সগর্বে সমস্ত ব্যাপারটা বলিলাম। শুনিয়া সে কিছুমাত্র উল্লাস প্রকাশ না করিয়া ব্যাকুলভাবে আমার হাত চাপিয়া ধরিল। কহিল, “ তুমি পাগল হইয়াছ? না না, সেখানে তুমি যাইতে পারিবে না। ”

আমি কহিলাম, “ রাজপুতনারী যুদ্ধসাজ পরাইয়া স্বামীকে রণক্ষেত্রে পাঠাইয়া দিত — আর বাঙালির মেয়ে কি বক্তৃতাসভাতেও পাঠাইতে পারে না। ”

নির্ঝরিণী কহিল, “ ইংরেজি বক্তৃতা হইলে আমি ভয় করিতাম না, কিন্তু — থাক্‌ না, অনেক লোক আসিবে, তোমার অভ্যাস নাই — শেষকালে —”

শেষকালের কথাটা আমিও কি মাঝে মাঝে ভাবি নাই। রামমোহন রায়ের গানটা মনে পড়িতেছিল —

 

মনে করো শেষের সে দিন ভয়ংকর,

অন্যে বাক্য কবে কিন্তু তুমি রবে নিরুত্তর।

 

বক্তার বক্তৃতা-অন্তে উঠিয়া দাঁড়াইবার সময় সভাপতি যদি হঠাৎ ‘ দৃষ্টিহীন নাড়ীক্ষীণ হিমকলেবর ' অবস্থায় একেবারে নিরুত্তর হইয়া পড়েন, তবে কী গতি হইবে। এই-সকল কথা চিন্তা করিয়া পূর্বোক্ত পলাতক সভাপতিমহাশয়ের চেয়ে আমার স্বাস্থ্য যে কোনো অংশে ভালো ছিল, এমন কথা আমি বলিতে পারি না।

বুক ফুলাইয়া স্ত্রীকে কহিলাম, “ নিঝর, তুমি কি মনে কর —”

স্ত্রী কহিল, “ আমি কিছুই মনে করি না- কিন্তু আমার আজ ভারি মাথা ধরিয়া আসিয়াছে, বোধ হয় জ্বর আসিবে, তুমি আজ আমাকে ফেলিয়া যাইতে পারিবে না। ”

আমি কহিলাম, “ সে আলাদা কথা। তোমার মুখটা একটু লাল দেখাইতেছে বটে। ”

সেই লালটা সভাস্থলে আমার দুরবস্থা কল্পনা করিয়া লজ্জায় অথবা আসন্ন জ্বরের আবেশে, সে কথা নিঃসংশয়ে পর্যালোচনা না করিয়াই আমি ক্লাবের সেক্রেটারিকে স্ত্রীর পীড়ার কথা জানাইয়া নিষ্কৃতিলাভ করিলাম।