প্রকল্প সম্বন্ধেপ্রকল্প রূপায়ণেরবীন্দ্র-রচনাবলীজ্ঞাতব্য বিষয়পাঠকের চোখেআমাদের লিখুনডাউনলোডঅন্যান্য রচনা-সম্ভার |
নবীন বুঝলে চিঠির মধ্যে একটা কী কঠিন মার আছে। কুমুর মুখ দেখে করুণায় ওর মন ব্যথিত হয়ে উঠল। বললে, “বউরানী, তাঁর কাছে তো কালই তোমার যাওয়া চাই।”
“না, আমি যাব না।” যেমনি বলা অমনি আর থাকতে পারলে না, দুই হাত দিয়ে মুখ ঢেকে কেঁদে উঠল।
মোতির মা কোনো প্রশ্ন না করে কুমুকে বুকের কাছে টেনে নিলে, কুমু রুদ্ধকণ্ঠে বলে উঠল, “দাদা আমাকে যেতে বারণ করেছেন।”
নবীন বললে, “না না, বউরানী তুমি নিশ্চয় ভুল বুঝেছ।”
কুমু খুব জোরে মাথা নেড়ে জানিয়ে দিলে যে, সে একটুও ভুল বোঝে নি।
নবীন বললে, “তুমি কোথায় ভুল বুঝেছ বলব? বিপ্রদাসবাবু মনে করেছেন আমার দাদা তোমাকে তাঁদের ওখানে যেতে দিতে চাইবেন না। চেষ্টা করতে গিয়ে পাছে তোমাকে অপমানিত হতে হয়, পাছে তুমি কষ্ট পাও, সেইটে বাঁচাবার জন্যে তিনি নিজে থেকে তোমার রাস্তা সোজা করে দিয়েছেন।”
কুমু এক মুহূর্তে গভীর আরাম পেল। তার ভিজে চোখের পল্লব নবীনের মুখের দিকে তুলে স্নিগ্ধদৃষ্টিতে চুপ করে চেয়ে রইল। নবীনের কথাটা যে সম্পূর্ণ সত্য তাতে একটুও সন্দেহ রইল না। দাদার স্নেহকে ক্ষণকালের জন্যেও ভুল বুঝতে পেরেছে বলে নিজের উপর ধিক্কার হল। মনে খুব একটা জোর পেলে। এখনই দাদার কাছে ছুটে না গিয়ে দাদার আসার জন্যে সে অপেক্ষা করতে পারবে। সেই ভালো।
মোতির মা চিবুক ধরে কুমুর মুখ তুলে ধরে বললে, “বাস্ রে, দাদার কথার একটু আড় হাওয়া লাগলেই একেবারে অভিমানের সমুদ্র উথলে ওঠে।”
নবীন বললে, “বউরানী, কাল তা হলে তোমার যাবার আয়োজন করি গে।”
“না, তার দরকার নেই।”
“দরকার নেই তো কী? তোমার দরকার না থাকে তো আমার দরকার আছে বৈকি।”
“তোমার আবার কিসের দরকার?”
“বা! আমার দাদাকে তোমার দাদা যা-কিছু ঠাওরাবেন সেটা বুঝি অমনি সয়ে যেতে হবে! আমার দাদার পক্ষ নিয়ে আমি লড়ব। তোমার কাছে হার মানতে পারব না। কাল তোমাকে ওঁর কাছে যেতেই হচ্ছে।”
কুমু হাসতে লাগল।
“বউরানী, এ ঠাট্টার কথা নয়। আমাদের বাড়ির অপবাদে তোমার অগৌরব। এখন চোখে মুখে একটু জল দিয়ে এসো, খেতে যাবে। ম্যানেজার-সাহেবের ওখানে দাদার আজ নিমন্ত্রণ। আমার বিশ্বাস তিনি আজ বাড়ির ভিতরে শুতে আসবেন না, দেখলুম বাইরের কামরায় তাঁর বিছানা তৈরি।”
এই খবরটা পেয়ে কুমু মনে মনে আরাম পেলে, তার পরক্ষণেই এতটা আরাম পেলে বলে লজ্জা বোধ হল।
রাত্রে শোবার ঘরে মোতির মা’র সঙ্গে নবীনের ঐ কথাটা নিয়ে পরামর্শ চলল। মোতির মা বললে, “তুমি তো দিদিকে আশ্বাস দিলে। তার পরে?”
“তার পরে আবার কী? নবীনের যেমন কথা তেমনি কাজ। বউরানীকে যেতেই হবে, তার পরে যা হয় তা হবে।”
নতুন-গড়া রাজাদের পারিবারিক মর্যাদাবোধ খুবই উগ্র। এরা নিশ্চয় ঠিক করে আছেন যে, বিবাহ করে নববধূ তার পূর্ব-পদবীর চেয়ে অনেক উপরে উঠেছে। অতএব বাপের বাড়ি বলে কোনো বালাই আছে এ কথা একেবারে ভুলতে দেওয়াই সংগত।