প্রকল্প সম্বন্ধেপ্রকল্প রূপায়ণেরবীন্দ্র-রচনাবলীজ্ঞাতব্য বিষয়পাঠকের চোখেআমাদের লিখুনডাউনলোডঅন্যান্য রচনা-সম্ভার |
“গরম কাপড় নেই তোমার?”
“খেতাব পাবার দিনে মহারাজা দিয়েছিলেন, নাতির খাঁসির বেমারি হতেই ডাক্তারের কথায় তাকে দিয়েছি মা।”
কুমু একটি পুরোনো ছাই রঙের আলোয়ান পাশের ঘরের আলমারি থেকে বের করে এনে বললে, “আমার এই কাপড়টি তোমাকে দিলুম।”
মুরলী গড় হয়ে বললে, “মাপ করো মা, মহারাজা রাগ করবেন।”
কুমুর মনে পড়ে গেল, এ বাড়িতে দয়া করবার পথ সংকীর্ণ। কিন্তু ঠাকুরের কাছ থেকে নিজের জন্যেও যে ওর দয়া চাই, পুণ্যকর্ম তারই পথ। কুমু ক্ষোভের সঙ্গে আলোয়ানটা মাটিতে ফেলে দিলে।
মুরলী হাত জোড় করে বললে, “রানীমা, তুমি মা লক্ষ্মী, রাগ কোরো না। গরম কাপড়ে আমার দরকার হয় না। আমি থাকি হুঁকাবরদারের ঘরে, সেখানে গামলায় গুলের আগুন, আমি বেশ গরম থাকি।”
কুমু বললে, “মুরলী, নবীন ঠাকুরপো যদি বাড়ি এসে থাকেন তাঁকে ডেকে দাও।”
নবীন ঘরে ঢুকতেই কুমু বললে, “ঠাকুরপো, তোমাকে একটি কাজ করতেই হবে। বলো, করবে?”
“নিজের অনিষ্ট যদি হয় এখনই করব, কিন্তু তোমার অনিষ্ট হলে কিছুতেই করব না।”
“আমার আর কত অনিষ্ট হবে? আমি ভয় করি নে।” বলে নিজের হাত থেকে মোটা সোনার বালাজোড়া খুলে বললে, “আমায় এই বালা বেচে দাদার জন্যে স্বস্ত্যয়ন করাতে হবে।”
“কিছু দরকার হবে না, বউরানী, তুমি তাঁকে যে ভক্তি করো তারই পুণ্যে প্রতি মুহূর্তে তাঁর জন্যে স্বস্ত্যয়ন হচ্ছে।”
“ঠাকুরপো, দাদার জন্যে আর কিছুই করতে পারব না। কেবল যদি পারি দেবতার দ্বারে তাঁর জন্যে সেবা পৌঁছিয়ে দেব।”
“তোমাকে কিছু করতে হবে না, বউরানী। আমরা সেবক আছি কী করতে?”
“তোমরা কী করতে পার বলো?”
“আমরা পাপিষ্ঠ, পাপ করতে পারি। তাই করেও যদি তোমার কোনো কাজে লাগি তা হলে ধন্য হব।”
“ঠাকুরপো, এ কথা নিয়ে ঠাট্টা কোরো না।”
“একটুও ঠাট্টা নয়। পুণ্য করার চেয়ে পাপ করা অনেক শক্ত কাজ, দেবতা যদি তা বুঝতে পারেন তা হলে পুরস্কার দেবেন।”
নবীনের কথার ভাবে দেবতার প্রতি উপেক্ষা কল্পনা করে কুমুর মনে স্বভাবত আঘাত লাগতে পারত, কিন্তু তার দাদাও যে মনে মনে দেবতাকে শ্রদ্ধা করে না, এই অভক্তির ’পরে সে রাগ করতে পারে না যে। ছোটো ছেলের দুষ্টুমির ’পরেও মায়ের যেমন সকৌতুক স্নেহ, এইরকম অপরাধের ’পরে ওরও সেই ভাব।
কুমু একটু ম্লান হাসি হেসে বললে, “ঠাকুরপো, সংসারে তোমরা নিজের জোরে কাজ করতে পার; আমাদের যে সেই নিজের জোর খাটাবার জো নেই। যাদের ভালোবাসি অথচ নাগাল মেলে না, তাদের কাজ করব কী করে? দিন যে কাটে না, কোথাও যে রাস্তা খুঁজে পাই নে। আমাদের কী দয়া করবার কোথাও কেউ নেই?”
নবীনের চোখ জলে ভেসে উঠল।
“দাদাকে উদ্দেশ করে আমাকে কিছু করতেই হবে ঠাকুরপো, কিছু দিতেই হবে। এই বালা আমার মায়ের, সেই আমার মায়ের হয়েই এ বালা আমার দেবতাকে আমি দেব।”
“দেবতাকে হাতে করে দিতে হয় না বউরানী, তিনি এমনি নিয়েছেন। দুদিন অপেক্ষা করো, যদি দেখ তিনি প্রসন্ন হন নি, তা হলে যা বলবে তাই করব। যে দেবতা তোমাকে দয়া করেন না তাঁকেও ভোগ দিয়ে আসব।”