যোগাযোগ

“কোনো কথা আছে?”

“এমন কিছু নয়। দেখলুম ঠাকুরপোর মেজাজ কিছু চড়া, ভাবলুম তোমাকে একবার জিজ্ঞাসা করে জানি, নতুন প্রণয়ে খটকা বাধল কোন্‌খানটাতে। মনে রেখো বউ, ওর সঙ্গে কী রকম করে বনিয়ে চলতে হয়, সে পরামর্শ আমরাই দিতে পারি। বকুলফুলের ঘরে চলেছ বুঝি? তা যাও, মনটা খোলসা করে এসো গে।”

আজ হঠাৎ কুমুর মনে হল শ্যামাসুন্দরী আর মধুসূদন একই মাটিতে গড়া এক কুমোরের চাকে। কেন এ কথা মাথায় এল বলা শক্ত। চরিত্র বিশ্লেষণ করে কিছু বুঝেছে তা নয়, আকারে-প্রকারে বিশেষ যে মিল তাও নয়, তবু দুজনের ভাবগতিকের একটা অনুপ্রাস আছে, যেন শ্যামাসুন্দরীর জগতে আর মধুসূদনের জগতে একই হাওয়া। শ্যামাসুন্দরী যখন বন্ধুত্ব করতে আসে তাও কুমুকে উলটো দিকে ঠেলা দেয়, গা কেমন করে ওঠে।

মোতির মার শোবার ঘরে ঢুকেই কুমু দেখলে নবীনে তাতে মিলে কী একটা নিয়ে হাত-কাড়াকাড়ি চলছে। ফিরে যাবে যাবে মনে করছে, এমন সময় নবীন বলে উঠল, “বউদিদি, যেয়ো না, যেয়ো না। তোমার কাছেই যাচ্ছিলুম, নালিশ আছে।”

“কিসের নালিশ?”

“একটু বোসো, দুঃখের কথা বলি।”

তক্তপোশের উপর কুমু বসল।

নবীন বললে, “বড়ো অত্যাচার! এই ভদ্রমহিলা আমার বই রেখেছেন লুকিয়ে।”

“এমন শাসন কেন?”

“ঈর্ষা— যেহেতু নিজে ইংরেজি পড়তে পারেন না। আমি স্ত্রীশিক্ষার পক্ষে, কিন্তু উনি স্বামী-জাতির এডুকেশনের বিরোধী। আমার বুদ্ধির যতই উন্নতি হচ্ছে, ওঁর বুদ্ধির সঙ্গে ততই গরমিল হওয়াতে ওঁর আক্রোশ। অনেক করে বোঝালেম যে, এতবড়ো যে সীতা তিনিও রামচন্দ্রের পিছনে পিছনেই চলতেন; বিদ্যেবুদ্ধিতে আমি যে তোমার চেয়ে অনেক দূরে এগিয়ে এগিয়ে চলছি এতে বাধা দিয়ো না।”

“তোমার বিদ্যের কথা মা সরস্বতী জানেন, কিন্তু বুদ্ধির বড়াই করতে এসো না বলছি।”

নবীনের মহা বিপদের ভান করা মুখভঙ্গি দেখে কুমু খিল খিল করে হেসে উঠল। এ বাড়িতে এসে অবধি এমন মন খুলে হাসি এই ওর প্রথম। এই হাসি নবীনের বড়ো মিষ্টি লাগল। সে মনে মনে বললে, ‘এই আমার কাজ হল, আমি বউরানীকে হাসাব।’

কুমু হাসতে হাসতে জিজ্ঞাসা করলে, “কেন ভাই, ঠাকুরপোর বই লুকিয়ে রেখেছ?”

“দেখো তো দিদি, শোবার ঘরে কি ওঁর পাঠশালার গুরুমশায় বসে আছেন? খেটেখুটে রাত্তিরে ঘরে এসে দেখি একটা পিদ্দিম জ্বলছে, তার সঙ্গে আর-একটা বাতির শেজ, মহাপণ্ডিত পড়তে বসে গেছেন। খাবার ঠাণ্ডা হয়ে যায়, তাগিদের পর তাগিদ, হুঁশ নেই।”

“সত্যি ঠাকুরপো?”

“বউরানী, খাবার ভালোবাসি নে এতবড়ো তপস্বী নই, কিন্তু তার চেয়ে ভালোবাসি ওঁর মুখের মিষ্টি তাগিদ। সেইজন্যেই ইচ্ছে করে খেতে দেরি হয়ে যায়, বই পড়াটা একটা অছিলে।”

“ওঁর সঙ্গে কথায় হার মানি।”

“আর আমি হার মানি যখন উনি কথা বন্ধ করেন।”

“তাও কখনো ঘটে নাকি ঠাকুরপো?”