ভিখারিনী
চতুর্থ পরিচ্ছেদ

মোহনলালের সহিত কমলের বিবাহ প্রস্তাব হয়। কিন্তু তাহা সম্পন্ন না হওয়াতে মোহন মনে-মনে কিছু ক্রুদ্ধ হইয়া আছে। কমলের সমুদয় বৃত্তান্ত মোহনলাল প্রাতেই শুনিতে পাইয়াছিলেন এবং তৎক্ষণাৎ কুলপুরোহিতকে ডাকাইয়া শীঘ্র বিবাহের উত্তম দিন আছে কি না জিজ্ঞাসা করিলেন।
গ্রামের মধ্যে মোহনের ন্যায় ধনী আর কেহ ছিল না; আকুল বিধবা অবশেষে তাঁহার বাটীতে আসিয়া উপস্থিত হইলেন। মোহন উপহাসের স্বরে হাসিয়া কহিলেন, “এ কী অপূর্ব ব্যাপার! এত দিনের পর দরিদ্রের কুটিরে যে পদার্পণ হইল? ”

বিধবা। উপহাস করিয়ো না। আমি দরিদ্র, তোমার কাছে ভিক্ষা চাহিতে আসিয়াছি।

মোহন। কী হইয়াছে।

বিধবা আদ্যোপান্ত সমস্ত বৃত্তান্ত কহিলেন।

মোহন জিজ্ঞাসা করিলেন, “তা, আমাকে কী করিতে হইবে।”

বিধবা। কমলের প্রাণরক্ষা করিতে হইবে।

মোহন। কেন, অমরসিংহ এখানে নাই?

বিধবা উপহাস বুঝিতে পারিলেন। কহিলেন, “মোহন, যদি বাসস্থান অভাবে আমাকে বনে বনে ভ্রমণ করিতে হইত, অনাহারে ক্ষুধার জ্বালায় যদি পাগল হইয়া মরিতাম, তথাপি তোমার কাছে একটি তৃণও প্রার্থনা করিতাম না। কিন্তু আজ যদি বিধবার একমাত্র ভিক্ষা পূর্ণ না করো, তবে তোমার নিষ্ঠুরতা চিরকাল মনে থাকিবে।”

মোহন। আইস, তবে তোমাকে একটি কথা বলি। কমল দেখিতে কিছু মন্দ নহে, আর তাহাকে যে আমার পছন্দ হয় নাই এমনো নহে, তবে তাহার সহিত আমার বিবাহের আর তো কোনো আপত্তি দেখিতেছি না। তোমার কাছে ঢাকিয়া কী করিব, বিনা কারণে ভিক্ষা দিবার মতো আমার অবস্থা নহে।

বিধবা। অগ্রেই যে অমরের সহিত তাহার বিবাহের সম্বন্ধ হইয়া গিয়াছে।

মোহন কিছু উত্তর না দিয়া হিসাবের খাতা খুলিয়া লিখিতে বসিলেন। যেন কেহই ঘরে নাই, যেন কাহারও সহিত কিছু কথা হয় নাই। এ দিকে সময় বহিয়া যায়, দস্যু আছে কি গিয়াছে তাহার ঠিক নাই। বিধবা কাঁদিয়া কহিলেন, “মোহন, আর আমাকে যন্ত্রণা দিয়ো না, সময় অতীত হইতেছে।”

মোহন। রোসো, কাজ সারিয়া ফেলি।

অবশেষে যদি বিধবা বিবাহের প্রস্তাবে সম্মত না হইতেন, তাহা হইলে সমস্ত দিনে কাজ সারা হইত কি না সন্দেহস্থল। বিধবা মোহনলালের নিকট অর্থ লইয়া দস্যুকে দিলেন, সে চলিয়া গেল। সেই দিনই ভয়ে আশঙ্কায় ত্রস্তা হরিণীটির ন্যায় বিহ্বলা বালিকা মাতার ক্রোড়ে ফিরিয়া আসিল এবং তাঁহার বাহুপাশে মুখখানি প্রচ্ছন্ন করিয়া অনেকক্ষণ কাঁদিয়া কাঁদিয়া মনের বেগ শান্ত করিল।

কিন্তু অনাথিনী বালিকা এক দস্যুর হস্ত হইতে আর-এক দস্যুর হস্তে পড়িল।

কত বৎসর গত হইয়া গেল। যুদ্ধের অগ্নি নির্বাপিত হইয়াছে। সৈনিকেরা দেশে ফিরিয়া আসিয়াছে ও অস্ত্র পরিত্যাগ করিয়া এক্ষণে ভূমি কর্ষণ করিতেছে। বিধবা সংবাদ পাইলেন যে,অজিতসিংহ হত ও অমর কারারুদ্ধ হইয়াছে। কিন্তু কন্যাকে এ সংবাদ শুনান নাই।

মোহনের সহিত বালিকার বিবাহ হইয়া গেল।